Site icon The Daily Moon | Popular Bangla News | National | International | Education | Entertainment | Religion | Employment

মানব সত্তার প্রতি অবমাননা, পতিতা প্রথা নির্মূলে নেই কোনো উদ্যোগ

প্রতীকী ছবি

ড. সোহেল আহম্মেদ: সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা গভীর ক্ষত সারানোর চেষ্টা চলছে অবিরত। এর ফলে সব ক্ষত পুরোপুরি সেরে না উঠলেও এগুলোর পরিধি ও গভীরতা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকছে। সরকারের সাফল্যের খতিয়ানে এসব ক্ষত সারানোর প্রচেষ্টার বিবরণ চোখে পড়ে নিয়মিত। কিন্তু একটি ক্ষত সারানোর বিষয়ে উদাসীনতা সর্বত্র লক্ষণীয়।

আমি পতিতাবৃত্তির কথা বলছি। এটি মানব সমাজের একটি গভীর ক্ষত, এটি গোটা মানবতার জন্য চরম লজ্জার। কেউ কি কখনো সরকারের সাফল্যের তালিকায় পতিতাদের পুনর্বাসনের পরিসংখ্যান দেখেছেন? কখনো কি গণমাধ্যমে এমন শিরোনাম দেখেছেন যেখানে বলা হয়েছে সরকারের প্রচেষ্টায় দৌলতদিয়া বা সোনাগাজি পতিতাপল্লি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন একদল নারী! আমি দেখিনি। ছোটখাটো দুই-একটা ঘটনা ঘটে থাকলেও এর পেছনে রয়েছে ব্যক্তিগত বা বেসরকারি উদ্যোগ। কিন্তু এই বিশাল ক্ষত সারাতে সরকারি উদ্যোগ জরুরি।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে যখন দেখি দেশটির একদল গৃহহীন মানুষ প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় পাকা ঘরের মালিক হয়েছেন, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কসহ প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরা নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন তখন আমাদের মনে এ আশা জাগতেই পারে যে, দেশটিতে নিপীড়নমূলক পতিতা প্রথারও একদিন বিলুপ্তি ঘটবে। একটা গবেষণাধর্মী কাজের প্রয়োজনে প্রান্তিক মানুষ সম্পর্কে জানতে গিয়ে ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের পতিতাদের সার্বিক চিত্র দেখে আঁতকে উঠেছি। সে এক ভীতিকর অবস্থা, সে এক বিভীষিকাময় চিত্র। যা দেখলাম তাতে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশ ও ভারতে পতিতাবৃত্তি হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দগদগে গভীর ক্ষত।

পতিতাপল্লিগুলো যেন পৃথিবীর বুকে একেকটি নরক। পতিতাপ্রথার কারণে লাখ লাখ মানুষ বিয়ে বহির্ভূত অবৈধ যৌন সম্পর্ক গড়ার মতো মারাত্মক অপরাধ করতে পারছে অবলীলায়। এর পাশাপাশি যারা ব্যবহৃত হচ্ছে তারাও পৃথিবীতেই ভুগছে নরক যন্ত্রণায়। পতিতাদের জীবনকে আসলেই স্বাভাবিক মানব জীবন বলা চলে না। আমার মতে পতিতাবৃত্তির চেয়ে নির্মম প্রথা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। এটি প্রকাশ্য নারী নির্যাতন, মানবসত্তার অবমাননা। এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর হতে পারে না।

কেউ কেউ দাবি করেন, পতিতাপল্লিতে অনেকেই স্বেচ্ছায় এসেছে। আমি এই দাবির সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি এর পেছনে কোনো একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধ্যবাধকতা কাজ করে। নানা গবেষণা প্রতিবেদনেও এটা স্পষ্ট, বেশিরভাগ মেয়ে দারিদ্র্য আর প্রতারকের কবলে পড়ে এই কাজে জড়িয়েছে। সাধারণত কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় অসম্মানিত, অপমানিত আর অত্যাচারিত হতে চায় না।

একজন মানবাধিকারকর্মীকে বলতে শুনেছি, পতিতালয়ের মেয়েদের একেকজনকে জীবনে বহুবার অসম্পূর্ণ গর্ভপাত করাতে হয়। পরিচয় সংকটের কারণে তারা হাসপাতালেও যেতে পারে না। আর তাই নিজেরাই কোনরকমে হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে গর্ভপাত ঘটায়। গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে অনেকের মৃত্যু ঘটে, কারো কারো দেহে আবার নানা জটিল রোগ বাসা বাধে। মানবাধিকার কর্মীদের অনেকেই জানিয়েছেন, পতিতালয়গুলোতে অন্যায়ভাবে বিকৃত যৌনাচার ও বলপূর্বক দলীয় যৌন নির্যাতন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে সব কিছু করতে বাধ্য হয় পতিতাপল্লির একজন নারী।

বাংলাদেশ ও ভারতে পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত নানা তথ্য ও প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে সবাই একথা স্বীকার করবেন যে, পতিতাপল্লির জীবন ব্যবস্থা নিপীড়নমূলক, সেখানে একজন নারী কেবলি পণ্য। বায়োলজিক্যালিও পতিতা হিসেবে জীবনযাপন একজন নারীর জন্য দুঃসহ, নারীর স্বাভাবিক শরীর-মন আজীবন এ ধরণের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য গঠিত হয়নি। সাধারণভাবে একাধিক পুরুষের সঙ্গী হওয়াও একজন নারীর জন্য শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে কষ্টদায়ক।

একজন নারী সাবালিকা হওয়ার পর থেকে প্রতিমাসে তার ভেতরে শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তার মধ্যে সন্তান ধারণের জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হতে থাকে। নারী যদি সন্তান গ্রহণ না করে তাহলে সেই আয়োজনের উপাদানগুলো রজক্ষরণের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। শারীরবৃত্তিয় এই প্রক্রিয়া রজঃস্রাব বা মাসিক নামে পরিচিত। এই সময়টা নারীর জন্য স্বাভাবিক কোনো সময় নয়। নারীরা কোনো নিরোধক ছাড়া স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কে জড়ালে গর্ভধারণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। গর্ভবতী অবস্থাতেও একজন নারী যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বাভাবিক থাকতে পারে না।

সন্তানলাভের পরও এ ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা ব্যত্যয় ঘটে। এরপর রয়েছে রজনিবৃত্তি বা মেনোপেজ। নারীর জীবনে এটি এমন এক সময় যখন সাধারণভাবে একজন নারী আর সন্তান ধারণ করতে পারে না। এ সময় নারীর শারীরবৃত্তিয় বাসনা অনেক কমে যায়। এ অবস্থায় একজন নারী সন্তান লালন-পালন এবং পরিবারের প্রতি মায়া-মমতায় অনেক বেশি সুখ অনুভব করে।

পতিতাদের নানা নামে অভিহিত করা হয়। অনেকে যৌনকর্মী শব্দটি ব্যবহার করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। তারা পতিতাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দায়মুক্তি পেতে চান। কিন্তু কেবল নাম পরিবর্তন করে কখনোই পতিতাদের সমস্যার সমাধান হবে না। পতিতাদের প্রতি ব্যক্তিগত বা সামাজিক দায় পূরণ করতে হলে এই নির্মম পেশাটি নির্মূলে এগোতে হবে। সুচিন্তিত উপায়ে এই ক্ষত সারিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশে দশকের পর দশক ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন নারী প্রধানমন্ত্রী।

এক দশক ধরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্ষমতায় আছেন একজন নারী রাজনীতিবিদ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম উচ্চারণের কারণ হলো এই রাজ্যেই রয়েছে এশিয়া তথা গোটা বিশ্বের সর্ববৃহৎ পতিতাপল্লি ‘সোনাগাজি’। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই ক্ষত সারাতে বড় কোনো সরকারি কর্মসূচি কখনোই চোখে পড়েনি। মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের সরকারও বরাবরই এ বিষয়ে উদাসীন। সেদেশে দৌলতদিয়াসহ ২০টির মতো পতিতাপল্লিকে অনুমোদন দিয়ে রাখা হয়েছে বহু আগে থেকেই। এছাড়া বড় শহরগুলোর আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট পতিতালয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে লক্ষাধিক পতিতা রয়েছে যারা সমাজে একেবারেই নিগৃহীত, প্রতিদিন কয়েক লাখ পুরুষ তাদের কাছে খদ্দের হিসেবে যায়। কোনো সমাজই এ ধরণের কাজে জড়িতদের সম্মানের চোখে দেখে না।

ইসলাম ধর্মে পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই ধর্মে বিয়ে বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজগুলোর একটি বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং এ জন্য নারী-পুরুষ উভয়কেই নির্মম শাস্তির সংবাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নরকের এই দরজা বন্ধের জন্য আলেম সমাজের পক্ষ থেকেও কোনো মানবিক ও যৌক্তিক পরিকল্পনা বা উদ্যোগের দেখা মেলেনি কখনোই। বাংলাদেশে নানা সময়ে ক্ষমতার শরীক হয়েছেন কোনো কোনো ধর্মীয় রাজনৈতিক দল। তারাও এ বিষয়ে মাথা ঘামাননি।

পতিতাবৃত্তি নির্মূলে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের আশা করাও বোকামি। কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেসব দেশ এখন প্রতাপশালী তারা এই পতিতা প্রথাকে বাণিজ্যশিল্প হিসেবে নিয়েছে। সেখানেও দরিদ্র মেয়েরাই এই শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই বিভিন্ন দরিদ্র দেশ থেকে পাচারের শিকার। সেখানেও দারিদ্র্যই পতিতাবৃত্তির প্রধান কারণ।

পাশ্চাত্যের নানা দেশ বিশেষকরে ইউরোপের দেশগুলোর কথাই ধরা যাক। ইউরোপের রেড লাইট সিটিগুলোতে হাঁটলেই দেখা যায়, স্বল্পবসনা নারীরা কাচে ঘেরা ছোট্ট স্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে প্রদর্শন করছেন নানা অঙ্গভঙ্গিতে। অন্যান্য পণ্যের শোকেসের সঙ্গে এসব শোকেসের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। রেড লাইট সিটির সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়া খদ্দেরদের দেখে মনে হয়, তারা দাস কেনাবেচার কোনো বাজারে ঢুকেছেন এবং তাদের মাথায় একটাই ভাবনা কার শরীরটা বেশি উপভোগ্য হবে।

মানবাধিকারের ঠিকাদার হিসেবে দাবিদার পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলো খুব সহজেই পতিতাদের পুনর্বাসন করতে পারত, কিন্তু নানা অজুহাতে এই কুৎসিত প্রথার শেকড়কে ক্রমেই আরও শক্তিশালী করছে তারা। পতিতাবৃত্তির সঙ্গে মানবপাচার ও মাদকাসক্তিসহ নানা মারাত্মক অপরাধ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পতিতা প্রথা বিলুপ্ত হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণও খানিকটা সহজ হবে। পাশাপাশি এইডসসহ নানা মারণব্যাধির বিস্তার কমবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশে পতিতা প্রথা নির্মূলে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আন্তরিক উদ্যোগ নেয়া হলে তাতে বেশিরভাগ মানুষই শামিল হবে বলে আমার বিশ্বাস। আসলে কোনো অভিভাবকই চান না তার সন্তান পতিতাপল্লিতে যাক, কোনো স্ত্রীই চান না তার স্বামী পরনারীতে মেতে উঠুক। এ কারণে পতিতাবৃত্তির বিলুপ্তিকে গণপ্রত্যাশা বললে উত্যুক্তি হবে না। অন্যান্য প্রত্যাশার মতো এর বাস্তবায়ন দেখতেও খুব ইচ্ছে করে। ‘দৌলতদিয়ার দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি পেলেন একদল নারী’, ‘সোনাগাজির পতিতাপল্লী থেকে দলবেধে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছেন নারীরা’- এমন শিরোনাম দেখতে খুব ইচ্ছে করে।

যেভাবে দেহব্যবসায় ঝুঁকছেন করোনায় কর্মহীন শিক্ষার্থীরা

লেখক: রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক।

Exit mobile version