ফাতিহুল কাদির সম্রাট: আমাদের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের মান খাদের গভীরে পতিত হয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে রংচঙা অবয়ব ধারণ সহজ হলেও সংবাপত্রে পেশাদারত্ব গেছে হারিয়ে। পত্রিকা পড়তে গেলে পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। সবচেয়ে বিরক্তিকর ঠেকে সংবাদ এবং রিপোর্টের দুর্বল উপস্থাপনা, বাক্যগঠনের অসংগতি, যথাশব্দের অনুপস্থিতি এবং বানান বিভ্রাট। কখনো কখনো মনে হয় সাংবাদিকতায় আর শিক্ষিত মানুষ নেই।
কিছুদিন আগে আমার এক সাবেক সহকর্মী, যিনি দেশের অন্যতম একটি মিডিয়াগ্রুপের বড় পজিশন ধরে আছেন, তাঁর সাথে সাক্ষাতে বললাম, আপনাদের প্রিন্ট মিডিয়া তো বেরোয় অসম্পাদিতরূপে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্ক্রলও ভুলে ভরা অবস্থায় দৌড়ায়। এ বিষয়টি আপনাদের নজরে আসে না? তিনি জবাবে বললেন, এখনকার মিডিয়া মালিকদের কাছে মান ও শুদ্ধতা হাস্যকর বিষয়। আর বানান ও ভাষার শুদ্ধতা অবান্তর প্রসঙ্গ। সম্পাদনায় জনবল বৃদ্ধির বিষয়টি তাঁদের কাছে অপচয়মাত্র। উত্তর শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম।
দুটি নমুনা দেই। ‘প্রথম আলো’র (২৭ মে, ২০২১) নতুন ডাকভবন উদ্বোধন সংক্রান্ত রিপোর্টের প্রথম দুটি প্যারা—
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর আগারগাঁওয়ের শেরেবাংলা নগরে হারিয়ে যেতে বসা ডাকবাক্সের আদলে ১৪ তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ডাক বিভাগের সদর দপ্তর ‘ডাকভবন’ উদ্বোধন করেছেন।
আর এর মাধ্যমে আধুনিক স্থাপত্য নকশায় ১৫০ ফুট উঁচু গাড়ি পার্কিং–সুবিধাসহ দুটি বেসমেন্টসহ ১৪ তলাবিশিষ্ট লেটারবক্সের আকৃতিতে নির্মিত ডাক বিভাগের নতুন সদর দপ্তরের যাত্রা শুরু হলো।”
প্রথম প্যারার সাথে দ্বিতীয় প্যারার সাদৃশ্য বিচার করলে বোঝা যায় ‘প্রথম আলো’র মতো লিডিং পত্রিকার আলুমার্কা সাংবাদিকতার বহর। দ্বিতীয় প্যারায় নতুন কোনো তথ্য নেই, প্রথম প্যারার রিপিটেশন মাত্র। দুটি প্যারাই এক বাক্যবিশিষ্ট। পার্থক্য বলতে শুধু দ্বিতীয় প্যারায় পথম প্যারার “ডাকবাক্সের আদল” হয়েছে “লেটারবক্সের আকৃতি”। “পার্কিং–সুবিধাসহ দুটি বেসমেন্টসহ” চার শব্দের মধ্যে দুইবার ‘সহ’যোগ অসহনীয় ঠেকে বৈকি। ব্যাসমেন্ট দুটি গাড়ি পার্কিং না গাড়ি পার্কিং আলাদা তার কিনারা করা মুশকিল। আর ১৫০ ফুট উচ্চতা কিসের? গোটা ভবনের, দুটি ব্যাসমেন্টের না গাড়ি পার্কিংয়ের সেটা বুঝতেও মাথায় দেড়শ ফুটি ফিতার প্যাঁচ লেগে যায়! সংক্ষিপ্ত ও নিটোল বাক্যে রিপিটেশনমুক্ত করে কথা বলা সত্যি কঠিন বাজ বটে!
আজ (২৯/৫/২০২১) ‘মানব জমিন’ পত্রিকায় বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে ভিরমি খেলাম। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা হতে অনূদিত ( মূল শিরোনাম “Fears for Bangladesh Garment Workers as Safety Agreement Nears an End” By Elizabeth Paton) রিপোর্টের একটি অংশ দেখুন।–“২০১৩ সালে ইউরোপিয়ান খুচরা ক্রেতা ইন্ডিটেক্স, এইচঅ্যান্ডএম, প্রাইমার্ক, বাংলাদেশের শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কারখানা মালিকরা ঐতিহাসিক দ্য একর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।” অনুবাদকের বিদ্যার দৌড় ভয়ংকর। নিউ ইয়র্ক টাইমসের যে অংশটির অনুবাদ সেটুকু হলো- “in 2013 by European retailers like Inditex, H&M and Primark, labor unions and Bangladeshi factory owners, was a landmark, legally binding agreement for the global apparel industry.” এখানে retailer শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছে ‘খুচরা ক্রেতা’।
ইন্ডিটেক্স, এইচঅ্যান্ডএম, প্রাইমার্ক এগুলো যে পোশাকের বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড তা কে না জানে। এরা নিজেদের অর্ডারমতো পাইকারি পোশাক কিনে চেইন শপের মাধ্যমে খুচরা বিক্রি করে থাকে। অনুবাদক বা সাব এডিটর বিক্রেতাকে ক্রেতা না হয় বানালেন, কিন্তু খবর যেসব দায়িত্বশীলের হাত হয়ে সম্পাদিতরূপে প্রেসে যায় তা কী করলেন?
সংবাদ মাধ্যম মানুষের ভাষাবোধ, বানানজ্ঞান এবং ভাষিক রুচি গঠনের অনুষঙ্গ। আধুনিককালে সংবাদপত্রকে বলা হয় warehouse of knowledge বা জ্ঞানভাণ্ডার। কিন্তু সেই জ্ঞানগুদাম যদি পচা ও রদ্দি মালে ঠাসা থাকে তাহলে মানুষের জ্ঞানস্বাস্থ্যের কী দশা হবে?
অনুবাদের ক্ষেত্রে হাস্যকর কথা মিডিয়া হাউজগুলোতে প্রচলিত। বিদেশি নিউজ এজেন্সি খবর পাঠাল, `President Fired ……Minister’. সাংবাদিক অনুবাদ করলেন., ‘প্রেসিডেন্ট ……মন্ত্রীকে গুলি করেছেন।’ অনুবাদে কী সমস্যা হয়েছে তা জানতে চাইলে ঐ সাংবাদিকের এক সহকর্মী সগর্বে উত্তর দেন, ‘প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীকে পুড়িয়ে মেরেছেন।’ প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীকে যা করেছিলেন, সেটি (বরখাস্ত) ঐ সাংবাদিকের ওপর কার্যকর হয়েছিল কি না তা অবশ্য জানা যায়নি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ