ফাতিহুল কাদির সম্রাট: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন বলে জোর প্রচার আছে এদেশে। আমাদের দেশে একটি অশুভ ও অসঙ্গত প্রবণতা হলো রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মধ্যে তুলনা করা। এই তুলনায় অনিবার্য নিয়ামক রবীন্দ্রনাথের আভিজাত্যের বিপরীতে নজুরলের দারিদ্র্য। অনেকে বলার চেষ্টা করেন যে, নজরুল যদি রবীন্দ্রনাথের মতো স্বচ্ছল হতেন তাহলে তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে আরো বেশি অবদান রাখতে পারতেন। আরেকটি কথা বেশ পপুলার যে, নজরুল দুঃখকষ্টে ছিলেন বলে গরিব-অসহায় মানুষদের প্রতি তাঁর দরদ ছিল অকৃত্রিম। রবীন্দ্রনাথ সমাজের উচ্চাসনে থাকার কারণে নিচের মানুষদের প্রতি তাঁর সহানভূতি ছিল না। এই পারসেপশন দাঁড় করানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবেই। এই তুলনায় দুই মহান সৃষ্টিপাগল মানুষকেই ছোট করা হয়। তাঁদের মাঝে তুলনা অবান্তর, তা সে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে হোক আর সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবেই হোক। দুইজন দুই মাপের দুই প্রকৃতির। তাঁরা তাঁদের মতো, অনন্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিজাত পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সারাজীবন সুখের সাগরে ভেসেছেন এমন ভাবা মহা অন্যায়। মানুষের শ্রেণি রুচি আর মানসচেতনার কারণে দু:খের প্রকাশ আলাদা হয়। কেউ চিৎকার করে কাঁদে, কেউ অশ্রুহীন নীরব কান্নায় মরে। আভিজাত্য আর উচ্চাদর্শ রবীন্দ্রনাথকে কেঁদে দু:খভার লাঘবের সুযোগটিও দেয়নি। সকল বেদনাভার বুকে চেপে নি:শব্দ নিরশ্রু থাকা যে কতখানি মর্মভেদী তা সাধারণ্যে বোধগম্য হবার নয়।
এটা সত্য, রবীন্দ্রনাথকে খাওয়াপরার অভাববোধ স্পর্শ করেনি। কিন্তু সারাটি জীবন সংসারে সুখের দেখা পেয়েছেন খুব কমই। বিশাল জনাকীর্ণ পরিবারের তাঁর জন্ম। বাবা-মার চৌদ্দ সন্তানের কনিষ্ঠতম তিনি। মায়ের আদর তাঁর কপালে জোটেনি। চাকরবাকরদের পরিচর্যায় বেড়ে উঠা রবীন্দ্রনাথ ‘আমার ছেলেবেলা’ রচনায় সব বৃত্তান্ত লিখে গেছেন। জনবহুল বাড়িতে থেকেও নি:সঙ্গ রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম বন্ধু বউদি কাদম্বরী দেবী। দুই কিশোর-কিশোরীর এ বন্ধুত্বে অনুরাগের রং হয়তো লেগেছিল মানবীয় দাবিতেই। কাদম্বরীর ঠাকুরবাড়ি ত্যাগ এবং আত্মহত্যা রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম বড় কষ্টের চাবুক। নানা পারিবারিক টানাপোড়েন আর স্বজন হারানোর মিছিল আর থামেনি। স্ত্রী, পুত্র ও একে একে তিন কন্যাসহ আরো কয়েকজন প্রিয় মানুষের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে শোকপাথরে পরিণত করেছিল। কাদম্বরীর বিষয়টি সব সময় পরিবারে অস্বস্তি জিইয়ে রেখেছিল। তারপর আদরের কন্যাদের মধ্যে কলহ, তাঁদের অসুখী দাম্পত্যজীবন ও মৃত্যুর শোক তাঁকে অসীম শূন্যের ওপারে এক অনির্দেশ্য সত্তায় আত্মলীন করে তোলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিক আদর্শের সাথে সমাজবিধির দ্বন্দ্বে তাঁর পরাজয়ের প্রমাণ তিন কন্যাকেই এগারো থেকে চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে দেওয়া। সেই বিয়েতে যৌতুকের লেনদেন রবীন্দ্র-আদর্শে না গেলেও এ লেনদেনে কবিগুরু ছিলেন দাতাপক্ষ। ক্ষয়রোগে মৃতপ্রায় কন্যাকে নিয়ে অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ ছুটেছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। কিন্তু অনবার্য পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে শিরোধার্য করে। জামাতাদের, বিশেষ করে সবচেয়ে আদরের, সবার বড় যে মেয়ে, সেই মাধুরীলতার স্বামী শরৎকুমার রবীন্দ্রনাথকে যে অপমানে জর্জরিত করেছিল তা তিনি কীভাবে সয়ে গেছেন ভেবে পাই না।
মাধুরীলতা (১৮৮৬-১৯১৮) রবীন্দ্রনাথকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আদর করে তাঁকে ডাকতেন বেলা নামে। ছোটবেলা থেকে বুদ্ধি ও সৃজনশীলতার ছাপ ছিল তাঁর মধ্যে। বিশ্বকবি তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন নিজের শিল্পীসত্তার উত্তরাধিকার। তাই তিনি তাকে প্রথাগত স্কুলে পাঠাননি। বরং বিলেতি নারী হাউস টিউটর দিয়ে শিক্ষিত করে তুলতে চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে লিখেছেন যে, ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মিনি হলো বেলার প্রতিভূ। কিন্তু বেলার সাথে ‘হৈমন্তী’ গল্পের হৈমন্তীর সাদৃশ্য বেশি। এ গল্পের আদর্শিক ঋষিপুরুষ গৌরীশঙ্কর বাবু বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কেউ নয়। এ গল্পে দশ হাজার টাকা যৌতুকের কথা আছে, যে টাকা গৌরীশঙ্কর বাবু জোগাড় করেছিলেন ধারে। পিতা-কন্যার অশ্রুশূন্য বিদায়, পরিহাস, পাত্রপক্ষের নির্মম অপমান এবং পরিশেষে হৈমন্তীর তিল তিল মৃত্যু সবই বেলা আর তাঁর পিতা রবীন্দ্রনাথেরই জীবনসত্যের অনুরণন।
প্রথা মেনে যথারীতি তের বছর বয়সে বেলার বিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ।জামাই শরৎকুমার চক্রবর্তী ছিলেন বাংলা কাব্যের ভোরের পাখিখ্যাত বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে। বিহারীলাল গত হয়েছিলেন। কবিপত্নী রবীন্দ্রনাথের কন্যা বলে পণের পণ থেকে থেকে সরে দাঁড়াননি। রফা হয়েছিল ১০ হাজার পাঁচ টাকা। এ সময় জমিদারি ভালো যাচ্ছিল না। কবির হাত ছিল খালি। ওদিকে পণ গুণে না দিলে বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক বন্ধুর নিকট এক পত্রে সমস্যার কথা জানিয়ে লিখেছিলেন যে, পাত্রের মা কোনো টাকা বাকি রাখবে না, নিশ্চিত। হাতেও টাকা নেই। কারো কাছে ধার করাও দায়। কারণ কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ তখনো জীবিত। তিনি যদি পরের কাছে হাত পাতার কথা জানতে পারেন তাহলে আর কবিকে আস্ত রাখবেন না। শেষাবধি টাকা জোগাড় হয়েছিল এবং বিয়েও হয়েছিল যথারীতি। মেয়ের সুখের কথা ভেবে জামাইকে নিজ খরচে বিলেত পাঠিয়ে উকিল বানিয়ে এনেছিলেন।
বড় মেয়ে বেলা ও কনিষ্ঠা মীরা স্বামীসহ বাবার বাড়িতে প্রতিপালিত হতে থাকেন। বেলার বিয়ে ঠাকুরবাড়ির অন্যরা মেনে নিতে পারেনি। মীরার সাথেও বেলার সম্পর্ক বিষিয়ে উঠে। দুই বোনের ঝগড়াঝাটি পারিবারিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে বড় দু:খের কারণ ছিল এই, তাঁর প্রিয় বেলা মীরার প্রতি পক্ষপাতিত্বের জন্যে তাঁকেই অভিযুক্ত করছিলেন। নোবেল পাওয়ার পর বরীন্দ্রনাথের সংবর্ধনায় সবাই গেলেও যাননি কেবল বেলা, কবির সবচেয়ে আদরের সন্তান।
একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদেশে যাওয়ার পর পারিবারিক অশান্তি চরমে উঠে। দেশে ফিরে দেখেন বেলাকে নিয়ে তাঁর স্বামী ভাড়া বাসায় উঠেছেন। বেলাকে শরৎকুমার মাথার দিব্যি দিয়ে পিতার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বারণ করে দেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্নেহার্দ্র পিতৃহৃদয় ছিল আকুল। সমস্ত অপমান ও লজ্জার মাথা খেয়েও মেয়ের সাথে দেখা করতে যেতেন। জামাইয়ের অফিসটাইমে চাদর মুড়ি দিয়ে লুকিয়ে যেতেন। মুখোমুখি বসে পিতা-কন্যার অব্যক্ত সময় কেটে যেত। একদিন জামাই অসময়ে বাসায় ঢোকে শ্বশুরকে দেখে কিছুই বলেননি। শুধু চেয়ারে বসে ডাইনং টেবিলে পা উঠিয়ে সিগারেট ফুঁকেছিলেন। পিতার এ অপমান বেলা সইতে পারেননি। অচিরেই ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে নীরবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান তিনি।
প্রমথ চৌধুরীর বর্ণনায় বেলার মৃত্যুর দিনের একটি মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাওয়া যায়। সাপ্তাহিক নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা বসেছিল কবির বসার ঘরে। এমন সময় কেউ একজন খবর দেয় বেলা আর বেঁচে নেই। কবি কোনো কথা বললেন না। ‘একটু বসো’ এই বলে তিনি কাঠের সিঁড়ি ভেঙে উপরে গেলেন। উপস্থিত সবাই স্তব্ধ। কী বরবেন বুঝতে পারছিলেন না। মিনিট দশেক পরে সৌম্যকান্তি রবীন্দ্রনাথ ধীরপায়ে নিচে নামলেন দেবদূতের মতো। চোখে পানি নেই, কান্নার কাতরতা নেই। সবচেয়ে প্রিয় সন্তানের বিয়োগব্যথাকে কীভাবে তিনি লুকিয়ে রাখলেন তা সবার কাছে হয়ে রইল রহস্য। নিচে নেমে তিনি শুধ বললেন, ‘আজ না হয় থাক।’ সবাই নি:শেব্দে চলে গেলেন। এই হলো দু:খনীল রবীন্দ্রনাথের একটুখানি পরচিয়াংশ।
নজরুল প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর শবের পাশে বসে লিখেছিলেন অমর গানের কলি–
‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হ’য়ে আমার গানের বুলবুলি –’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর লিখলেন-
‘আজ জোসনা রাতে সবাই গেছে বনে।’
একজনের চরণে মৃত্যুর প্রকাশ আর আরেকজনের চরণে এক রহস্যময় আলোর খেলা। একই রকম ঘটনায় দুই মহান কবির অনুভূতির প্রকাশভঙ্গিতেই তাঁদের স্বাতন্ত্র্য বুঝা যায়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ