ফাতিহুল কাদির সম্রাট: আল জাজিরা এক রিপোর্টে বলেছে যে, ভারতের শ্মশানগুলো দিনরাত সমানে জ্বলছে। ক্রমাগত জ্বলার কারণে শ্মশানের ধোঁয়া নির্গমনের চিমনিগুলো গলে গলে পড়ছে। কবরস্থানে জায়গা ফুরিয়ে আসছে অনেক দেশে।
চ্যানেলটি বলছে, ভারতে সরকারিভাবে করোনায় মৃত্যুর যে হিসেব দেওয়া হচ্ছে বাস্তবের হিসেব তার চেয়ে অনেক বেশি। সরকারি হিসেব মতে গতকাল ভারতে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে রেকর্ড ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮০২ জন এবং মারা গেছে সর্বোচ্চ ২ হাজার ১০২ জন। পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই ভয়াবহ। ভারতের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যেও এলার্মিং। কারণ বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে ভারতবেষ্টিত। মানুষের জীবনাচারণও প্রায় একইরকম। ভারতের করোনাঝড় বাংলাদেশকেও কাঁপিয়ে দেবে, নিশ্চিত।
করোনাকালে বিজ্ঞান ও ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর বিষয়টি লক্ষ্যযোগ্য। আমাদের অনেক হুজুর বলেছিলেন, ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি বলে কিছু নেই। করোনা মুসলমানদের কিছু করতে পারবে না। ওটা বিধর্মী দুনিয়ার নষ্টামির ফল। আল্লাহর গজব। কিন্তু আজ প্রমাণিত করোনা ধর্ম-বর্ণ-ভৌগোলিক সীমানার উর্ধ্বে। মানুষ মুক্তবাজার ও বিশ্বায়ন চেয়েছিল, করোনা সারা দুনিয়াকে এক কাতারে একই সমান্তরালে দাঁড় করিয়েছে। সত্যি, করোনা বিশ্বসাম্যের ধারণাটি উচ্চকিত করেছে। সাম্যবাদীরা করোনাকে বাহবা দিতেই পারে।
আমাদের অনেক আলেম মানুষের ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়েছেন। ভারতের গোমূত্রসেবী ধর্মগুরুরা মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে আরো বেশি। গোবরস্নান ও গোমূত্র সেবনের সেই নিদানের কারবারিরা আজ নীরব। অনেক হুজুরও চুপ করে গেছেন। হুজুরদের বোঝার কথা যে, করোনা যদি আল্লাহর গজব হয় তাহলে সেটি সবার আগে মুসলমানদেরই পাকড়াও করবে। কোরানে পূর্ববর্তী বিভিন্ন অনাচার ও পাপগ্রস্ত জাতির ওপর গজবের কথা আছে। অভিশপ্ত জাতি সেগুলো যাদের হেদায়াতের জন্যে আল্লাহ নবি-রসূল পাঠিয়েছেন। সত্যের বাণী তাদের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল তা সত্ত্বেও তারা আল্লাহর অবাধ্য হয়েছিল।
লূত, নূহ ও মুসার সম্প্রদায়কে আল্লাহ শাস্তি দিয়েছিলেন সত্যের বাণী পেয়েও তা অগ্রাহ্য করার কারণে। আজকের দিনে সারা বিশ্বে মুসলমানরা কি আল্লাহর পথে আছে? বাড়ি বাড়ি মসজিদ থাকা আর অন্তঃসারশূন্য ধর্মাচার মানেই কি ইসলাম? মোটেই না। ইসলাম মানে শান্তি, খোদাভীতি, পাপমুক্তজীবন। ইসলাম মানে মানবতা, উদারতা, ইনসাফ, সত্যাশ্রয় ও সর্বজনীন কল্যাণ। আজকের মুসলমানরা পতনের যে খাদে পৌঁছেছে তাতে মুসলমানদের গজব প্রাপ্তি অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু হুজুররা মানুষদের বুঝিয়েছেন উল্টো।
আমাদের কিছু প্রগতিবাদী ভাই ওপরের গজবে বিশ্বাসী নয়। তারা বিজ্ঞানের ওপর অতি আস্থা রেখে করোনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। টিকা আবিষ্কারের অগ্রগতি শুনেই তারা প্রচার করতে শুরু করেছিল, ‘এবার বাঁচলে বিজ্ঞানের কারণে বাঁচব।’ এটা একটা ভয়ংকর কথা। বিজ্ঞান মানুষকে মারতে পারে সহজে, কিন্তু বাঁচাতে পারে না। পারলে দুনিয়াতে একজন অমর মানুষ অন্তত থাকত।
অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের কারণে বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা যেমন মূর্খতা, তেমনি বিজ্ঞানকে নিরঙ্কুশ মনে করাও বোকামি। আমাদের বিজ্ঞানের অবদান টিকাসহ চিকিৎসা যেমন গ্রহণ করতে হবে, তেমনি বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলতে হবে। আর ভরসা করতে হবে সৃষ্টিকর্তার ওপর। জীবন-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক আল্লাহ আর বিজ্ঞান হলো তারই দেওয়া ক্ষমতার প্রয়োগ, উসিলামাত্র এটা বিশ্বাস করতে হবে।
আমার এক আধা নিরীশ্বরবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক বন্ধুর সাথে কয়েকদিন আগে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম সে আগের মতো বিজ্ঞাননির্ভরতায় আর নেই। কারণ সে ‘আল্লাহ বাঁচায়ে রাখলে দেখা হবে, ভালো থেকো’ বলে কথা শেষ করেছিল। তাকে বললাম, এই যে অতিক্ষুদ্র করোনা, যার দেহে প্রোটিন ছাড়া কিছু নেই, সে যে ক্রমাগত মিউটেশন করছে, রং বদলাচ্ছে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা কী? নাকি অদৃশ্য এক মহাশক্তি করোনাকে সাজঘরে নিয়ে নতুন নতুন রূপ দিয়ে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পাঠাচ্ছে মানুষকে সাইজ করার জন্যে? বন্ধুটি শুধু বলল, হতে পারে।
গোর খোদকরা ক্লান্ত, শ্মশানের চিমনি পড়ছে গলে কিন্তু মানুষের মন কি গলছে? মানুষ করোনা নামক মৃত্যুদূতের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কি নিজেকে শুধরালো? যারা করোনাকে খোদায়ী গজব মনে করেন তাঁদের চরিত্রেও এলো কোনো পরিবর্তন? না, মোটেই না। বরং করোনাকালে অনাচার-অবিচার-পাপের স্ফীতি ঘটেছে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে। করোনা এ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ। মনে হয় এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে করোনা যেতে চাইছে না বলেই তার ফিরতি যাত্রায় এত বিলম্ব হচ্ছে।
আমরা ভালো হয়ে যাই। তবেই হয়তো করোনা যাবে। সবার জীবন মঙ্গলময় হোক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ