হেফাজত নেতা মামুনুল হকের একাধিক বিয়ে বিতর্কের পর দেশে কাবিননামার বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। কাবিননামা বলতে সাধারণত মুসলিম বিয়ে সম্পাদনের একটি লিখিত চুক্তিকে বোঝানো হয়। এটাকে আবার নিকাহনামাও বলা হয়ে থাকে।
মনের মধ্যে প্রশ্ন হতেই পারে- এই কাবিননামার কাজটা কী? সংক্ষেপে বলতে গেলে পরিবারের ভরণ পোষণ, উত্তরাধিকার নির্ণয়করণ, সন্তানের পিতৃত্ব পরিচয়, স্ত্রীর দেনমোহর যাবতীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে এই কাবিননামা একটি আইনি দলিল। তবে মুসলিম ধর্মে একটি বৈধ বিয়ের জন্য কাবিননামা বাধ্যতামূলক নয়। সেক্ষেত্রে যদি বর পক্ষের অভিভাবক বিয়ের প্রস্তাব দেয় আর সেই প্রস্তাব যদি মেয়ের অভিভাবক গ্রহণ করে তবে সেটাকে বৈধ বিয়ে বলা যায়।
বিয়ে পরবর্তী জীবনে কাবিননামা একটি আইনি সুরক্ষা দলিল। বিয়ের সময় কাবিননামা ঠিকভাবে সম্পন্ন করলে দেনমোহর ও যেকোনো পক্ষ থেকে তালাক দেওয়ার মত আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। কাবিননামাকে সরকারি দলিলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
মুসলিম শরীয়াহ আইন অনুযায়ী পবিত্র কালেমা পাঠ করে সাক্ষীদের সম্মুখে অভিভাবকের অনুমতিতে কাজী সাহেব বিয়ে পড়িয়ে দিলেই বৈধ বিয়ে বলে গণ্য হবে। কিন্তু আইনগত সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করতে কাবিননামার প্রয়োজন হয়।
মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী- প্রত্যেকটি বিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। বিয়ের পাত্র-পাত্রীর নাম; বিয়ের তারিখ; দেনমোহর ইত্যাদি বিষয়াদি সরকারি নথিতে লিখে রাখাই হলো নিবন্ধন। যে কাগজে এই নিবন্ধন করা হয় সেই তথ্য সংবলিত কাগজকেই কাবিননামা বলা হয়।
রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী কাবিননামা না করা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনমতে বিয়ের ৩০ দিনের মধ্যেই নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। অন্যথায় ৩ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ২ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা উভয় শাস্তিই হতে পারে। সামগ্রিক বিবেচনায় আইনি সুরক্ষা ও প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য বিয়ে অবশ্যই রেজিস্ট্রেশন করা উচিত । বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর কাজীর আইনগত দায়িত্ব হলো স্বামী ও স্ত্রীর উভয় পক্ষকে কাবিননামার বিষয়বস্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে দুই পক্ষকে ওই কপি সরবরাহ করা।
অনেক সময় কাজী অথবা যেকোনো পক্ষের মনে খারাপ চিন্তা থাকলে কাবিননামায় ছয়নয় করা হয়। এজন্য কাবিনামায় সই করার আগেই বিষয়বস্তু ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে। বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনের তাৎপর্যের কারণে এটিকে সরকারি দলিলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কাবিননামায় মোট ২৫টি বিষয় সন্নিবেশ করা হয়েছে। এই ২৫টি বিষয়ের মধ্যে ১৫, ১৮ ও ১৯ নং কলামটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলিম বিয়েতে কাবিননামাই বিয়ের চুক্তিপত্র। বিয়ে সংক্রান্ত কোনো সমস্যার প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে কাবিননামার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করতে পারলেই আদালত প্রতিকার দিবেন, অন্যথায় নয়। এমন ক্ষেত্রে কাজী সাহেব সাক্ষীদের উপস্থিতিতে কাবিননামার যে ২৫টি কলাম রয়েছে তা বর এবং কনে পক্ষকে বুঝিয়ে দিয়ে কাবিননামার বিষয়টি সম্পন্ন করবেন।
এই দলিলের ১৫ নং ক্রমিক বলা হয়েছে- বিয়ের সময় দেনমোহরের কোনো অংশ পরিশোধিত হয়েছে কিনা, যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটার পরিমাণ কতটুকু’এই অংশ কাজীর সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিশোধিত লেখা হয় তবে পরবর্তীতে কনে পক্ষ এই দেনমোহর নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।
আবার ১৮ নং কলামটি মেয়ে পক্ষের জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শরীয়াহ আইনমতে স্ত্রী ইচ্ছে করলে স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইনমতে, এই ১৮ নম্বর কলামটি স্ত্রীর পক্ষ হতে স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে এই কলামে কাজী অথবা বর পক্ষের প্রতারণার কারণে কনে পরবর্তীতে তালাক না দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তবে স্ত্রী কোনোভাবেই স্বামীকে তালাক দিতে পারবে না।
[সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক]