ফাতিহুল কাদির সম্রাট: আমার খুব পছন্দের একটি ছবি দু টুকরো হয়ে গেল। বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটস-এর ২৭ বছরের দাম্পত্যজীবনের যবনিকা ঘটল। তাঁরা যৌথ এক টুইটে দাম্পত্য জীবনের মধুর সময়গুলো স্মরণ করে বলেছেন, তাঁদের মনে হয়েছে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসাথে চলা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। তবে তাঁদের যৌথ দাতব্য কাজগুলো আগের মতোই চলবে।
খবরটা আমার কাছে খুব বেদনাদায়ক ঠেকছে কেনো তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু তাঁদের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানাতেই হবে। তাঁরা যাতে খুশি তাতেই আমাদের খুশি থাকা উচিত। তাঁদের বিচ্ছেদ নিয়ে এর মধ্যে সোশাল মিডিয়া সরব। আমাদের সমস্যা হলো এই যে, আমরা সবাইকে আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধ ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে চাই। এটা বিপজ্জনক। আমাদের সমাজে যেটা অসম্ভব সেটা অন্য সমাজে সেটা স্বাভাবিক। অন্য সমাজের বিষয়গুলোকে অন্যভাবেই দেখতে হবে।
আামদের সমাজে দীর্ঘ দাম্পত্য সম্পর্ক (অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমৃত্যু অটুট,) অবশ্যই একটি ভালো বিষয়। কিন্তু এই ভালোর বিপরীতে কালো দিকও যে নেই তা নয়। আমাদের দেশে দাম্পত্য সম্পর্কটা বলতে গেলে আরোপিত। অনেক ক্ষেত্রে তা জৈবিক চাহিদা ও সন্তান উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুজন নরনারী আজীবন পরস্পরের কাছে অচেনা থেকে একটি রিলেশনের ঘানি টেনে যাওয়ার নাম যে দাম্পত্য নয় সেটা আমরা বুঝি না। এমন অনেক স্বামী-স্ত্রী আছে যারা গার্হস্থ্য কিছু কর্তব্যের বাইরে আর কোনো কর্তব্যকে স্বীকার করতে জানে না। প্রেম, ভালোবাসা, রোমান্স, অবকাশ, অবসর, একে অপরকে বোঝা, শ্রদ্ধা করা এসব যে দাম্পত্যজীবনের অনুষঙ্গ তা শুনলে অনেকের পিলে চমকে যায়।
আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে থাকে দায়ে ঠেকার কারণে। বিশেষ করে নারীরা হলো এ দায়গ্রস্ত পক্ষ। দাম্পত্য সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার দুটি কারণ। প্রথমত নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের অভাব, দ্বিতীয়ত আমাদের চিরায়ত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিয়েকে নিয়তি হিসেবে দেখা। তবে আমাদের গর্ব করার দিন ফুরিয়ে এসেছে। হু হু করে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, আগে পুরুষ তালাক তালাক বলে নারীদের অবলা পশুর মতো তাড়িয়ে দিত, এখন নারীরা তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিবাহবিচ্ছেদ পরিসংখ্যান বলছে নারীরা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে পুরুষদের থেকে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। এক্ষত্রে কর্মজীবী এবং আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নারীরা বেশি এগিয়ে। দিনে দিনে নারীরা যত বেশি কর্মক্ষেত্রে ঢুকবে তাদের ডিভোর্স দেওয়ার হারও বাড়বে। হয়তো এমন দিন অপেক্ষা করছে যখন পুরুষরা সংসারচ্যুত হওয়ার ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকবে।
গেটস-মেলিন্ডার বিচ্ছেদ নিয়ে তাঁদের সমালোচনা কিংবা পশ্চিমা দুনিয়ার নিন্দা করার কোনো মানে নেই। যে সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে যায় তাকে দায়ে পড়ে টিকিয়ে রাখাটা এক ধরনের ভণ্ডামি। কাজেই গেটস দম্পতির সিদ্ধান্তকে আমাদের সম্মান জানাতে হবে। আমরা চাইব তাঁরা ভালো থাকুন। তাঁদের মানবিক দাতব্য কাজগুলো জারি রাখুন।
তাঁদের বিষয় ঘাঁটাঘাঁটির বদলে আমাদের দায়িত্ব হবে নিজেদের সম্পর্ক সজীব ও সুন্দর রাখার প্রতি সচেতন হওয়া। বস্তুগত প্রাপ্তির বাইরে হৃদয়লোকের সন্ধানকে গুরুত্ব দেওয়া। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও অধিকারকে স্বীকার করা। আসুন, মার্কিন মুল্লুকের গেটস দম্পতির বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের চড়কায় তেল দেই। আমাদের গৃহকোণকে করে তুলি সুখময় ও প্রেমপূর্ণ। তালাক নয় আমাদের জবানিতে উচ্চারিত হোক লাভ লাভ লাভ।
প্রসঙ্গত, দাম্পত্য সম্পর্কের সকল বৈধ এবং প্রেমপূর্ণ কথা ও কাজ ইবাদততুল্য।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ।