এম এ জব্বার: মসজিদের নগরী ঢাকা এখন ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। এ যেন মুসলমানদের দ্বিতীয় কিবলা অবৈধ দখলদার ইহুদি অধ্যুষিত যুদ্ধবিধ্বস্ত জেরুজালেম। হাতে জায়নামাজ নিয়ে সন্তানসহ নামাজ পড়তে এসে মসজিদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি না পেয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বাসায় গিয়ে নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। টু শব্দটি পর্যন্ত কেউ করতে চাইলে মুহূর্তেই তেঁড়ে আসেন মুসুল্লি সেঁজে মসজিদে যাওয়া সরকারদলীয় ক্যাডাররা।
বাকরুদ্ধ জাতি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করার জন্য মসজিদে প্রবেশের অধিকারটুকুও হারিয়ে আজ প্রথম রোজার দিন নিরবে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে এই অসহায়ত্ব প্রমাণ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এদেশের মানুষ কি পেয়েছে এবং কি হারিয়েছে। আজও হিসেবে গড়মিল হলে আরো কঠিন পরিণতি অপেক্ষা করছে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
চাকচিক্যময় নগরীর সারি সারি সুউচ্চ ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সর্বত্রই অন্ধকার এবং জনমানব শূন্য। অফিস-আদালত ব্যাংক-বীমা সবই বন্ধ। তবে লুটেরাদের অর্থের যোগান দিতে পোশাক শিল্প খোলা রাখা হয়েছে অজানা কারণে। মনে হয় রাষ্ট্রের কাছে পোশাক শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের জীবনের কোনই মূল্য নেই। ওদের জন্মই যেন জীবন বাজি রেখে রাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য।
ইতিপূর্বে তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা চাপা পরে হাজার হাজার শ্রমিক নিহতসহ সকল দুর্ঘটনায় দেখেছি তাদের জীবনের দাম ২৫ হাজার টাকা। কোন দুর্ঘটনায় শ্রমিক মারা গেলে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ২৫,০০০ টাকা দাফন-কাফনের জন্য দেয়া হয়; এটাই হয়তো তাদের জীবনের মূল্য। তাই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে আমাদের দেশের অর্থনীতি সচল রাখবেন।
আরও পড়ুন: মসজিদের গেটে তালা, প্রথম তারাবির পর ফেসবুকে ভাইরাল যে ছবিগুলো
অর্থনীতির স্বার্থে পোশাক শিল্প কারখানা খোলা রাখতে পারলেও কঠিন এই মুসিবতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য মসজিদ খোলা রাখার মত ঈমান সরকারের নেই। তাই সকল নিষেধাজ্ঞা যেন মসজিদের উপর। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নয়; এ যেন মসজিদ বন্ধ করার ভিনদেশীয় গভীর ষড়যন্ত্রের শতভাগ বাস্তবায়ন। মসজিদ-মাদ্রাসা বন্ধের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই বারবার মসজিদ মাদ্রাসা বন্ধের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। চলতি লকডাউনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি বরং বেড়েছে মসজিদের মিম্বর থেকে তুলে নিয়ে আলেম-ওলামাদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন।
হাজার হাজার স্কয়ারফিটের বড় বড় মসজিদগুলো যেখানে শত সহস্ত্র লোক নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই নামাজ পড়তে পারে; সেখানে কোন অজানা কারণে মাত্র ২০ জনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এ প্রশ্ন এখন সর্ব মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসব প্রশ্নের সদুত্তর মিলছে না। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে কেউই চাকরি হারাতে রাজি না।
পল্টন এলাকার মতো নগরীর প্রায় সকল মসজিদে ঝুলছে তালা। মসজিদের গেটে ঝোলা তালাগুলো যেন মুমিন হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আজানের সুমধুরকন্ঠ ও মানুষের কোলাহল সবকিছুই যেন এখন অতীত। ঈদের জামাতের মত তারাবির জামাতে ছোট ছোট শিশুদেরকে নিয়ে হাজির হওয়ার আনন্দ আজ মলিন। খতম তারাবির জন্য পাগল পারা মানুষগুলোর হাহাকার মুমিন হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। দোকানপাট বন্ধ,এমনকি মহাসড়ক ও অলিগলির লাইটগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে রাখা হয়েছে সরকারি নির্দেশে। আবাসিক এলাকার প্রবেশদ্বার সারাদিনই বন্ধ ছিল।
আজ প্রথম রমজান পুরান ঢাকার বাহারি ইফতারির মৌ মৌ গন্ধ কোথাও ছিলো না। ছিল না ইফতারির দোকানের সামনে মুসল্লিদের সরগরম।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত নগরীর মত বিশেষ প্রয়োজনে দুই-একজন বের হওয়া ছাড়া তেমন কাউকেই চোখে পড়ে নাই ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর রাস্তায়। সিকিউরিটি গার্ড এবং পরিচ্ছন্ন কর্মীরা কিছুটা বেরিয়েছেন তাও নির্দিষ্ট পোশাকে।
সবচেয়ে কষ্টে রয়েছে ফুটপাতে থাকা হতদরিদ্র মানুষ। যারা মানুষের কাছে হাত পেতে খেয়ে থাকে। তাদেরকে অভুক্ত থেকেই দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা রোজাদার তারা সেহরি ও ইফতার না খেয়েই হয়তো রোজা রাখবেন। রোজার মাস এলে তাদের খাদ্যের অভাব হয় না; অথচ রহমতের এই মাসেও তারা কুঁড়িয়ে খাওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত।
মিডিয়াকর্মী ও চিকিৎসক যারা পেশাদারিত্বের কারণে বেরিয়েছেন তারাও সর্বত্র প্রশাসনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত ছিলেন। মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় কর্মস্থলে আসার পাথে একজন ডাক্তারকে ৩,০০০ জরিমানা করেছে পুলিশ প্রশাসন।
ইফতারির আগ মুহূর্তে পল্টন মসজিদের মূল ফটকে ঝুলছে তালা। একজন রোজাদারের আর্তনাদ মসজিদের গেট খুলে দেওয়ার জন্য কিন্তু কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে গেট খুলছেনা ভেতর থেকে। অসহায় মানুষটির পাশে সাধারণ মুসল্লিদের কেউই এগিয়ে আসছেন না সরকার দলীয় লোকজনের হামলার আতঙ্কে। একজন রোজাদার বুক ভরা ব্যথা নিয়ে বাকবিতণ্ডা শেষে আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে বিদায় নিলেন মুখ খানা মলিন করে। পুরো নগরের চিত্রই অনেকটা একই রকম।
বায়তুল মোকাররম মসজিদের সকল গেটে ঝুলছে একাধিক তালা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও কোন লাইট জালানো হয়নি পরিকল্পিতভাবে। প্রতিবছরের ন্যায় সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে সর্বসাধারণের জন্য নেই কোনো ইফতারির আয়োজন। ভেতরে হাতেগোনা কয়েকজন নিজস্ব মুসল্লি যখন ইমামের নেতৃত্বে মাগরিবের নামাজ আদায় করছেন; ঠিক সেই মুহুর্তে উত্তর গেইটে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারা ক্ষুব্দ মুসল্লিদের একাকি নামাজ আদায়ের হৃদয় বিদারক দৃশ্য বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে ইয়াহুদী রাষ্ট্র জেরুজালেমের কথা।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী