ফাতিহুল কাদির সম্রাট: মুনিয়া-আনভীর কাণ্ডে অনেকে বলছেন বহুবিবাহ করার সুযোগ থাকলে মুনিয়াকে জীবন দিতে হত না, সমাজে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থাকত না। মুনিয়ার মৃত্যু নিয়ে আমার পোস্টেও বেশ কয়েকজন এমন মন্তব্য করেছেন। এমনকি বহুবিবাহের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন নারীরাও। মামুনুল কাণ্ডেও অনেকে বহুবিবাহের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
প্রশ্নটা হলো বহু বিবাহের সুযোগ অবারিত করে দিলেই কি এ ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক সমাজ থেকে উঠে যাবে? এ ক্ষেত্রে আমার মত স্পষ্ট, মোটেই না। আমরা জানি ইসলামে বৈধ কাজের মধ্যে সবচেয়ে বাজে কাজ তালাক। বহুবিবাহ স্বীকৃত হলেও ইসলাম এটাকে মোটেই প্রমোট করে না। উপরন্তু কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়ে তাকে নিরুৎসাহিতই করেছে। “বিবাহ কর নারীদের মধ্য হতে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই ,তিন অথবা চারটি। আর যদি আশঙ্কা কর যে (স্ত্রীদের মাঝে) সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে (মাত্র) একটি (বিবাহ কর) ।” (সুরা নিসা ০৩:০৩)
একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সাথে স্ত্রীদের প্রতি সুবিচারের যে শর্ত দেওয়া হয়েছে সেটি যে কোনো মানুষের পক্ষেই প্রতিপালন করা সম্ভব নয় সে বিষয়টি পরে আল্লাহ তায়ালা নিজেই খোলাসা করেছেন। আল্লাহ বলেন, “তোমরা যতই আগ্রহ রাখো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের সমদৃষ্টিতে দেখতে কখনো সক্ষম হবে না। “ (সুরা নিসা ০৪:১২৯)। কাজেই বাস্তবতার নিরিখে চারটি পর্যন্ত বিয়ের সুযোগ ইসলাম দিলেও এক স্ত্রীতে পরিতৃপ্ত থাকাটাকেই উৎসাহিত করা হয়েছে। উপরন্তু বহু বিবাহের পর স্ত্রীদের মধ্যে বৈষম্য করার জন্যে কঠিন শাস্তির কথা হাদিসে এসেছে। লক্ষণীয় যে, মহানবী স. জীবনে যা করেছেন তা-ই সুন্নত। তিনি একাধিক বিয়ে করেছেন কিন্তু একাধিক স্ত্রী গ্রহণ কিন্তু সুন্নত নয়।
যারা বহু বিবাহ দিয়ে বহুগামিতা রোধ করতে চান তারা ভুল করছেন। পুরুষের বহু নারীর প্রতি আসক্তি আসলে একটি মানসিক বিকার। এর পেছনে সক্রিয় কারণ যতখানি না শরীরী তার চেয়ে বেশি মানসিক। আনভীরদের মতো মানুষদের চারটি হুরসদৃশ বউ এনে দিলেও তারা দড়িছেঁড়া ষাঁড়ের মতো পরের খেতই খেতে যাবে। ইতোমধ্যে মুনিয়ার আরো কিছু অডিও ফাঁস হয়েছে যাতে বোঝা যায় আরো অনেক নারীর সাথে আনভীরের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। আমার পরিচিত মহলে এমন মানুষও ছিলেন এবং আছেন যাদের কাছে বিয়ে করাটা নেশার মতো। বউ রেখে পর নারীর সাথে ঢলাঢলি করাটা আরো বড় নেশা। কারো জন্যে আবার বহুগামিতা ফ্যাশন এবং বাহাদুরি। কেউবা একে ভাবেন বৈচিত্র্যবিলাস।
রিসোর্ট কাণ্ডের পর মামুনুল হক ফেসবুকে ‘একটি মানবিক বিয়ের গল্প’ নামে একটি কাহিনি লিখে নিজের দ্বিতীয় বিয়ের পক্ষে সাফাই দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। অনেকে মানবিকতার দোহাই দিয়ে এ বিয়ের পক্ষ নিয়েছিলেন। মামুনুল সাহেব ও তার সমর্থকদের বক্তব্যকে আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। মনে রাখতে হবে, বিয়ে কোনো দয়া বা করুণার বিষয় নয়। এটি নারী-পুরুষের যৌথজীবনের আইনগত ও ধর্মীয় স্বীকৃতি যাতে রয়েছে উভয়ের কাছে উভয়ের অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। পারস্পরিক সম্মান, আনুগত্য ও বিশ্বাস হচ্ছে এই সম্পর্কের ভিত্তি, দয়া বা করুণা নয়।
মানবিক বিয়ের নামে অসহায় নারীদের পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করা হলে সামর্থ্যবানদের চার বিয়েতেও সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ সমাজে নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অসহায় নারীর সংখ্যা অগণন। তাদের প্রত্যেকের জীবনে এমন সব বেদনার গল্প আছে যা শুনে শেষ করা যাবে না। এই অসহায় নারীদের সাপোর্ট দেওয়ার নানা উপায় আছে, কিন্তু তা অবশ্যই বিয়ে নয়। মানবিক বিয়ে প্রমোট করা হলে ঘরে ঘরে অমানবিক অশান্তির সৃষ্টি হবে, মানবতার বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। মানবিকতার বিষয়টি এক্ষেত্রে আসলে একটি ওজরমাত্র। আমি এমন কোনো দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা দেখিনি যে, দ্বিতীয় স্ত্রী প্রথম স্ত্রীর চেয়ে বয়সে বড়, দেখতে অসুন্দরী ও কম আবেদনময়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্ত্রী লালসালু উপন্যাসে জমিলার মতো।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অহেতুক মজিদকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। মজিদ তবু জমিলাকে বিয়ে করেছিল, এখনকার সভ্য ও ধনী মানুষেরা জমিলাদের টাকার বিনিময়ে যৌনদাসী করে রাখে। একালের জমিলারা প্রতিদিন হাতবদল হয়ে একদিন টয়লেট টিস্যুর মতো পরিত্যক্ত হয় সমাজের ঘৃণার ভাগাড়ে। নয়তো নিয়তি হয় হত্যা কিংবা আত্মহত্যা। বহুবিবাহ করার জন্যে বীর পুরুষ হওয়ার দরকার নেই। যদি বহুবিবাহ পৌরুষের প্রমাণ হত তাহলে উত্তরবঙ্গের মাইগ্রেটেড শ্রমিক আর রিকশাচালকেরা কেবল বীর নয়, মহাবীর।
ইসলাম বহুবিবাহের সুযোগ রেখেছে একটি কঠিন বিকল্প হিসেবে। বাংলাদেশের আইনেও শর্ত সাপেক্ষে বহুবিবাহের অনুমতি আছে। কিন্তু ধর্ম ও আইন কারো মানসিক বিকৃতি ও বিকার চরিতার্থ করার নিমিত্ত নয়। যৌক্তিক কারণ ও শর্ত পূরণের গ্যারান্টি ছাড়া একাধিক বিয়ে কামপীড়িত মানুষের বিকৃত লালসা চরিতার্থ করার উপায় মাত্র।
যারা বহুবিবাহের পক্ষে কথা বলছেন তারা করতেই পারেন কিন্তু একে প্রমোট করা অনুচিত। আমরা যারা এক স্ত্রীতে পরিতৃপ্ত তাদের কাপুরুষ বললেও কম্পাসের কাঁটার মতো থাকব, দিকপরিবর্তন করার সম্ভাবনা নাই। স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা ও পাপ থেকে দূরে থাকা একালে শুধু নয় ওকালেও সুখে থাকার নিয়ামক। একাধিক বিয়ে বা বান্ধবীর সান্নিধ্যের কাঙাল না হয়ে আপনার ঘরে যিনি আছেন তাঁকে মাঝে মাঝে শুনান—–
আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি
তবু মনে হয় এ যেনো গো কিছু নয়
কেনো আরো ভালোবেসে যেতে পারে না হৃদয়
আমি এত যে…………………….
দেখবেন, লাইফ ইজ বিউটিফুল। লাইফ ইজ পিসফুল।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ
লেখক থেকে আরো পড়ুন:
রাজপথে ডাক্তার-পুলিশ-মেজিস্ট্রেট বিতণ্ডা ও কিছুকথা
শ্মশানের চিমনি গলে পড়ছে, গলছে না মানুষের মন