গত এক বছরে বিশ্বে নতুন করে দুই কোটি মানুষ খাদ্যসংকটে পড়েছে। করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার কারণে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকট, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে এই বিপুল পরিমাণ মানুষের তিনবেলা ন্যূনতম খাবারও জুটছে না। গত বছর এ ধরনের খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৫০ লাখ। এ বছর তা ১৫ কোটি ৫০ লাখে পৌঁছেছে। বিশ্বের যে ৫৫টি দেশে খাদ্যসংকটে পড়া মানুষের বাস, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। সম্প্রতি বৈশ্বিক খাদ্যসংকট প্রতিবেদন ২০২১-এ এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর জোট ‘গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস’ এক যুগ ধরে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ ১৮টি সংস্থা এই জোটের সদস্য। প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে সংস্থাগুলো থেকে বিশ্বনেতাদের খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের সহায়তায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে পুরো কক্সবাজার এলাকা খাদ্যসংকটে। বিশ্বের ১৫ কোটি ৫০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটে। কক্সবাজার জেলার বাসিন্দাদের ৭০ শতাংশই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে মূলত কক্সবাজার জেলার কারণে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি খাদ্যসংকটের কারণ, জেলাটির ১২ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৭০ শতাংশই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
যারা জেলার বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের খাবার, বাসস্থান ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে।
এদিকে রাজনৈতিক সংঘাত ও যুদ্ধের কারণে খাদ্যসংকট বেড়ে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে দেশটির মধ্যে ২৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। তারা দেশটির বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। আর ১৪ লাখ মানুষ পাকিস্তানের আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের সামগ্রিক ক্ষুধা পরিস্থিতি বোঝাতে পুষ্টির অবস্থার কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ৫ বছরের কম বয়সী ৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু কৃশকায়। আর ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ খর্বকায় বা স্বাভাবিকের চেয়ে বেঁটে। মূলত অপর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে শিশুদের এসব সমস্যা হয়। আফগানিস্তানে কৃশকায় শিশুর সংখ্যা ৬ দশমিক ৩ শতাংশ ও খর্বকায় ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। পাকিস্তানে এই সংখ্যা যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৭ ও ৪০ দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে দেশের প্রায় এক কোটি অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুঁজি হারিয়েছেন। এর বড় একটা অংশ শহরে থাকলেও গ্রামে তাঁদের পরিবার ও আত্মীয়রা থাকেন। তাঁদের আয় কমে যাওয়ার প্রভাব তাই গ্রাম ও শহর দুই জায়গাতেই পড়েছে। তাঁরা সরকারের করোনার প্রণোদনা সহায়তা পাননি।
ফলে এসব পরিবারের শিশুরা আগের চেয়ে খাবার কম পাবে। চিকিৎসাসেবাও কমে আসবে। এটাই স্বাভাবিক। সে কারণে এসব মানুষের জন্য আলাদা তহবিল তৈরি করে প্রণোদনা দিলে নিজেরাই আবার উঠে দাঁড়াবে। আর আপাতত সারা দেশের দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও খাদ্যসহায়তা দেওয়া শুরু করতে হবে। নয়তো দেশে দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতা বাড়বে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করোনার কারণে বাংলাদেশের শিশুদের কৃশকায় অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হতো, তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনার আগের সময়ের তুলনায় ৭৪ শতাংশ কার্যক্রম নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যসহায়তা ২০১৯-এর তুলনায় অর্ধেকের বেশি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালে করোনার কারণে এসব আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার ৬২ শতাংশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার কারণে দেশের সাধারণ নাগরিকদের অনেকেই জীবিকা ও খাবারের সংকটে থাকলেও রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে আমরা তা হতে দিইনি। তবে তাদের মিয়ানমারে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে গেলে বাংলাদেশের ওপর অর্থনৈতিক ও খাদ্যের চাপ কমত।’
প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুরকিনা ফাসো, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেনের ১ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ খাদ্যসংকটের কারণে মৃত্যুর মুখে আছে। তাদের জন্য দ্রুত খাদ্যসহায়তা দেওয়া দরকার। খাদ্যসংকটে থাকা অন্য শীর্ষ দেশগুলো হচ্ছে সিরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, বুরকিনা ফাসো, হন্ডুরাস, মোজাম্বিক, সিয়েরা লিওন, উগান্ডা ও ক্যামেরুন।