মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডব’।’ স্বর্ণসময়ে’র পাঁচ সারথি।’ স্বর্ণসময়’ বলতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট যে সময়টা পার করে এসেছে, তার মধ্যে সেরা সময়।
দুই-একটি বিচ্ছিন্ন সাফল্য ছাড়া বাংলাদেশের বড় বড় জয়গুলোতে এই পাঁচ তারকার কারও না কারও অবদান আছেই। অনেক সময় তারা ম্যাচ জিতিয়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়েও। তাদের কাছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ঋণ অনেক।
এই পাঁচজনের মধ্যে একটা দিক দিয়ে ব্যতিক্রম হয়ে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। প্রথম চারজনই ক্যারিয়ারে অনেকবার বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন। কখনো বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তারা নিজেরা, কখনো তাদের বিতর্কে টেনেছেন অন্যরা। বোর্ডের সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েও বোমা ফাটিয়েছেন।
শুধু মাহমুদউল্লাহই পার করছিলেন নিস্তরঙ্গ এক ক্যারিয়ার। পারফরম্যান্স দিয়ে আলো কেড়েছেন। আবার পারফরম না করে আঁধারেও হারিয়েছেন। কিন্তু ব্যাট আর বল ছাড়া তাঁকে নিয়ে অন্য আলোচনা কখনো করতে হয়নি। বাকিরা অনেক সময় অন্যায়-বঞ্চনার প্রতিবাদ করে আলোচনায় এসেছেন। মাহমুদউল্লাহ তাও নন। তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনে এমন কোনো দাগ নেই যেটার পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক হতে পারে। হয় তিনি ভালো খেলেছেন, অথবা খারাপ খেলেছেন। এর বাইরে আর কোনো আলোচনারই বিষয় হননি কখনো মাহমুদউল্লাহ। সেটা আসলে তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও যায় না। ব্যক্তিগত জীবনে ভদ্র, বিনয়ী আর সুশৃঙ্খল মানুষ হিসেবেই তাঁর পরিচয়।
যদি কখনো মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে অকারণ সমালোচনা হয়েও থাকে, দল থেকে তিনি অন্যায়ভাবে বাদও পড়ে থাকেন; তবু মাহমুদউল্লাহ টু শব্দটি করেননি। অন্য অনেকের মতো মিডিয়ার কানে কানে এসে বলেননি, ‘আমার সঙ্গে তো ঠিক করা হলো না! ‘ কোনো অভাব-অভিযোগ না জানিয়ে নীরবে করে গেছেন নিজের কাজ। অনেকটা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের আত্মত্যাগী বড় ছেলের মতো। অন্যরা নানা অভাব-অভিযোগ নিয়ে কখনো সখনো সরব হলেও তাঁকে কোনো দিন বলতে শোনা যায়নি, ‘আমার এটা চাই। ওটা আমাকে দাওনি কেন? ‘
এই প্রথম মাহমুদউল্লাহ এমন একটা কাজ করলেন, যেটা তাঁকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এল। তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনার সৃষ্টি হলো।
তা কি করেছেন মাহমুদউল্লাহ? টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরই তো নিয়েছেন! যেটা এক সময় না এক সময় সবাই-ই নেন। কি খেলবেন আর কি খেলবেন না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ অধিকার অবশ্যই একজন খেলোয়াড়ের আছে। কিন্তু প্রশ্ন তো অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে নয়। প্রশ্ন সে সিদ্ধান্ত জানানোর স্থান-কাল নিয়ে। যেটি জাতীয় দলের একজন অভিজ্ঞ, দায়িত্বশীল এবং অনুসরণীয় ক্রিকেটার হিসেবে মাহমুদউল্লাহর বিচক্ষণতার সঙ্গেও যায় না।
তার ওপর তিনি তো একজন অধিনায়কও! কাঁধে তাঁর টি-টোয়েন্টি জাতীয় দলের নেতৃত্ব। টেস্ট দলের অধিনায়ক নন বলে তো আর এই নয় যে টেস্টের ড্রেসিংরুমে তিনি ঢুকবেন নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অন্য কোথাও রেখে এসে। যে অধিনায়ক, তাকে সব জায়গায় অধিনায়কের মতোই চিন্তা করতে হয়। একজন রাজা যেমন সিংহাসনে না বসে অন্য কোথাও বসলেও রাজাই থাকেন।
মাহমুদউল্লাহ ঠিক এই জায়গাতেই ভুলটা করে বসলেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারে টেস্টের তৃতীয় দিনে ড্রেসিংরুমে সতীর্থ সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে বলে দিলেন, এই টেস্টের পর সাদা পোশাকের ক্রিকেট আর খেলবেন না। হারারে টেস্টই তাঁর শেষ টেস্ট। মাহমুদউল্লাহ যেন ভুলে গেলেন এই দলটার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় তিনি। কেন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত, সে ব্যাখ্যা দেননি মাহমুদউল্লাহ। তবে বলেছেন, এ রকম কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন বলে আগের তিন রাত তিনি ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেননি।
আগামী ২৫ জুলাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৪ বছর পূর্ণ হবে মাহমুদউল্লাহর। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি নিশ্চয়ই ভালো করেই জানেন, একটা ম্যাচ চলাকালে বা একটা সিরিজের সময় দলের আবহটা কেমন থাকে। খেলোয়াড়েরাও মানুষ এবং তাঁদের ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি থাকবেই। কিন্তু খেলার মধ্যে থাকা অবস্থায় সেগুলোতে নিয়ন্ত্রণ থাকাটা জরুরি। মাহমুদউল্লাহর মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের কাছে সে প্রত্যাশা আরও বেশি করেই থাকবে। অথচ তিনি নিজেই কিনা টেস্টের মাঝপথে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ড্রেসিংরুমের হাওয়া এলোমেলো করে দিলেন! ম্যাচ থেকে খেলোয়াড়দের মনঃসংযোগ নাড়িয়ে দিলেন। দলের ভেতরেরই খবর, ওই ঘটনার পর থেকে হারারের ক্রেস্টা লজে (যেখানে বাংলাদেশ দল আছে) মোটামুটি একটা থমথমে অবস্থা।
এটা ঠিক যে, মাহমুদউল্লাহর এমন কাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব দলের খেলায় দেখা যায়নি। সেটা হয়তো ওই ঘটনার আগেই টেস্টে বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে চলে যাওয়ায়। শেষ পর্যন্ত ২২০ রানের বিশাল জয় তুলে নিয়ে সতীর্থরা তাঁকে দারুণ এক বিদায়ী উপহারই দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কারণে যদি একটা অঘটন ঘটেই যেত, তার দায় তো মাহমুদউল্লাহকেই নিতে হতো। জিম্বাবুয়ের টেল এন্ডাররা যেভাবে ম্যাচটাকে টেনে শেষ দিন চা বিরতি পর্যন্ত নিয়ে গেলেন এবং বাংলাদেশের ফিল্ডারদের হাত ফসকে যেরকম ক্যাচ পড়ছিল, তাতে বাংলাদেশের জেতা ম্যাচ ড্র হয়ে গেলে কিন্তু খুব অবাক হওয়ার কিছু থাকত না।
টেস্টের মাঝপথে ড্রেসিংরুমে ঘটা করে অবসরের সিদ্ধান্ত জানানোর আগ মাহমুদউল্লাহর আরেকটু বিচক্ষণ হওয়াই বোধ হয় উচিত ছিল। তিনি সিদ্ধান্তটা ম্যাচের শেষে জানাতে পারতেন। আর সিদ্ধান্ত জানানোর আগে যেহেতু তিন রাত ঘুমাতে পারেননি বলে জানিয়েছেন, তার অর্থ এই সিদ্ধান্ত তাঁর আগেই নেওয়া। সে ক্ষেত্রে টেস্টের আগেও সতীর্থদের বলে দেওয়া যেত, ‘এটাই আমার শেষ টেস্ট।’ মাহমুদউল্লাহ এর কোনোটাই না করে টেস্টর মাঝখানে দলের আবহ ভারী করে তুললেন।
বিসিবি সভাপতি বলেছেন, জিম্বাবুয়ে আসার আগে মাহমুদউল্লাহ লিখিতভাবে জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশের হয়ে তিন সংস্করণের ক্রিকেটেই খেলতে চান। কাজেই তাঁর টেস্ট না খেলার সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য। ব্যাপারটি একান্তই মাহমুদউল্লাহ আর বিসিবির বলে সে আলোচনায় আমরা না-ই গেলাম। তবে লিখিত দিয়েছেন বলেই মাহমুদউল্লাহ সে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবেন না, ব্যাপারটা তেমনও নয়। মূল প্রশ্নটা আসলেই ওখানেই-একজন সিনিয়র ক্রিকেটার হয়ে, একজন অধিনায়ক হয়েও খেলার মধ্যে তিনি কীভাবে ড্রেসিংরুমে ওরকম একটা বোমা ফাটালেন?
হতে পারে আবেগের বশবর্তী হয়ে। হতে পারে অন্য কোনো কারণে। তবে কারণ যেটাই হোক, কাজটা যে তাঁর সঙ্গে যায় না, সেটি নিশ্চয়ই মাহমুদউল্লাহও একসময় বুঝবেন। টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষে দেশে ফিরে যখন কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে কফির মগ হাতে বাসার বারান্দায় বসবেন, তাঁর নিজের মনেই হয়তো উঁকি দেবে প্রশ্নটা-আমি কি ঠিক করলাম? [সূত্র: প্রথম আলো]