ফাতিহুল কাদির সম্রাট: নয়া দামান গান এখন সোশাল মিডিয়ার প্রাণ। বহু আগের এই সিলেটি আঞ্চলিক লোকগানটি নতুন ফ্লেভারে সামনে এনেছেন তোসিবা নামের একি তরুণী (সাথে গাওয়া মুজাহিদ ছেলেটি প্রাসঙ্গিক মনে হয় না)। দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় গানটি। এরপর করোনা ভাইরাসের চেয়েও দ্রুত সংক্রামক হয়ে উঠেছে গানটি।
নারী-পুরুষ একক বা সম্মিলিতভাবে মাতোয়ারা এ গান নিয়ে। হুজুগের জোশে গানটিকে বিকৃত করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, তোসিবার গলায় গানটি সত্যি উপভোগ্য হয়েছে। কিন্তু আধুনিক বাদ্যবাজনার প্রয়োগ , র্যাপ মিউজিক ও ফিউশন মিশ্রণের ফলে এই গানটি তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এই প্রবণতা অন্যান্য লোকগানকে সংক্রমিত করলে লোকগান তার চিরায়ত মেজাজ ও স্বকীয়তা হারাতে পারে।
এটি একটি বিয়ের গীত বা গান। বাংলাদেশের যতরকমের বিয়ের গীত আছে তার উপাদান প্রধানত তিনটি। এক. নতুন জামাইয়ের আবাহন বা বন্দনা দুই. কনে পক্ষের প্রতি নিন্দা বা গালি ও তিন. স্থূল ঢলাঢলির অশ্লীলতা। পুরুষশাসিত এই সমাজ বিয়ে বিষয়টিকে দেখায় কন্যাদায় থেকে মুক্তির উপলক্ষ হিসেবে। এখানে মুক্তিদাতা পক্ষ বর আর উদ্ধার পাওয়া পক্ষ কনে। তাই বিয়ের আলোচনা পর্ব থেকেই পাত্রপক্ষ থাকে আপার হ্যান্ড এবং তাদের খাইখাতির হয়ে দাঁড়ায় কনেপক্ষের নিয়তি।
পড়ুন: বহুবিবাহ কি বহুগামিতা রোধের বিকল্প?
বিয়ের পরেও বিশেষত জামাইয়ের মনরক্ষার নামে আদর-তোয়াজের ঢল থামে না। এর বিপরীতে কনের জীবনে শুরু হয় সংসারধর্মের পুলসিরাত পাড়ি দেওয়ার পরীক্ষা। পদে পদে তার ভুল, উদয়াস্ত তার শ্বশুর বাড়ির মনোতুষ্টির প্রাণান্ত চেষ্টা। একদিকে জামাইয়ের পদপ্রান্তে আদরের অঞ্জলি, অন্যদিকে নববধূর পান থেকে চুন খসার ভয়ে কম্পমান অবস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্বশুর বাড়িতে নতুন জামাইয়ের আগমন বাংলাদেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন আসার চেয়েও বড় ঘটনা।
এদেশে জামাই তোয়াজের পথ ধরে ‘জামাই আদর’ প্রবচনটি দাঁড়িয়ে গেছে। বিয়ের মাধ্যমে নারী-পুরুষের স্বীকৃত যুগলজীবনের সূচনা যা বংশপরম্পরা রক্ষার উপায়, তাতে বরপক্ষ নয় কনেপক্ষ আপার হ্যান্ড হওয়া উচিত। কারণ একটি কন্যাকে স্নেহমমতা, পরিচর্যা, পরিপোষণ, শিক্ষা সবকিছু দিয়ে সংসারধর্ম চালানোর উপযুক্ত করে স্বামীর ঘরে পাঠান কনের বাবা মা। আজকের নববধূ আমৃত্যু স্বামীসংসারকে আগলাতে গিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেবেন। এই বধূর রক্ত চুষে জ্বলবে বংশের বাতি। যে পরিবারের বুহবিধ বিনিয়োগের ফল এই গৃহলক্ষ্মী সে পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর বদলে সমাজ তাদের কাছ চায় শুধু চায়। সংসার নামক দুই চাকার গাড়ির একটি চাকা স্বামী আরেকটি স্ত্রী। কিন্তু দুটি চাকার মূল্য কখনো সমান দিতে শেখায়নি এই সমাজ।
আইলারে নয়া দামান গানে দামান হলো আকাশের তারা। এই তারার মূল্য বেড়ে যায় পূজা পার্বণ আর ঈদের সময়। এই যে সমাগত ঈদ তা অনেক জামাইয়ের লোলুপ রসনাকে লকলকে করে তুলেছে। আর কপালে ভাঁজ ফেলেছে কন্যার অভাবী বাবার। জামাইয়ের মন উঠানোতে মন না দিলে কন্যার কপালে জোটে অনাদর-অবহেলা ভর্ৎসনা আর লাঞ্ছনা।
আমরা গ্রামে দেখেছি এই ফলের মৌসুমে জামাই বাড়িতে আম-কাঁঠাল-দুধের পসরা পাঠাতে। আম টক হলে কিংবা দুধের কলসি কানা পর্যন্ত ভরা হলে ফেরত পাঠানোর দৃশ্য আমি দেখেছি। বারো মাসে তেরো পার্বণে জামাইকে দাওয়াত না করলে, ভেট-পুটলি না পাঠালে মেয়ে শান্তিতে থাকে না। সামনে কুরবানির ঈদে অনেক এলাকার জামাই গোঁফে তা দেবেন নিদেনপক্ষে তাগড়া খাসির খায়েশে। কনের বাবার সামর্থ্য কখনোই বিবেচনায় আসে না। ঋণ করে, নিজে না খেয়ে হলেও জামাই আদরে ঘাটতি রাখা চলে না। আমাদের দেশের এই জামাই আদরকে আমার কাছে মনে হয় আত্মপীড়নের অসভ্যতা।
পড়ুন: মুনিয়াদের দুনিয়া
প্রসঙ্গত, বলে রাখি আমার কন্যা নেই। আছে দুটি ছেলে। আমার ছেলেদের হাত ধরে যে দুটি মেয়ে আমার সংসারে আসবে তাদের বাবা-মার কাছে আগাম কৃতজ্ঞতা। তাদের কারণেই আমি দুটি রেডিমেড মেয়ে পেয়ে যাবো। তারা আমার কাছে আপার হ্যান্ড।
নয়া দামান গানের মধ্যে আনন্দের আবহ আছে কিন্তু তার আড়ালে লুকিয়ে আছে জামাই নামক সামন্তপ্রভুর তোয়াজ আর কনেপক্ষের আত্মসমর্পিত চেতনার প্রকাশ। যে ছেলে-মেয়েগুলো একসাথে নাচতে নাচতে গানটি গাইছে বাস্তব জীবনে তাদের অবস্থান সমান্তরাল নয়। যে মেয়েরা হাসি-আনন্দে গানের সাথে নাচছে তাদের অনেকের জীবন জামাইয়ের মনোতুষ্টির জন্যে নিবেদিত হলেও জামাইকে পূর্ণ অধিকারে পাওয়া হবে না। কারণ জামাই তো আকাশের তারা, তাকে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
মেয়েরা জানে না যে এ গানের আড়ালে রয়েছে তাদেরই পীড়নবার্তা। তবু তারা নেচেগেয়ে মজা নিচ্ছে, নিক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ