ডা. সাজেদুল ইসলাম নাহিম: চলে গেছে মধুমাস জ্যৈষ্ঠ, তবে এখনো বাজার ছেড়ে যায়নি গ্রীষ্মের রসালো ফলগুলো। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু তরমুজ, জামরুল- গ্রীষ্ম কেবল দাবদাহই ছড়ায় না, উপহার দেয় এমন রসালো ফলও, যা ভুলিয়ে দেয় গরমের ক্লান্তি-অবসাদ। ফলমূল কেবল রসনাকেই তৃপ্ত করে না, যোগায় শক্তিও। আয়ুর্বেদের সূত্র হলো, একটি অঞ্চলে কোনো মৌসুমে যে রোগবালাই হয়ে থাকে তার প্রতিষেধক থাকে সেখানে উৎপন্ন মৌসুমি ফলে।
অর্থাৎ, আপনি যদি মৌসুমি ফল খান তাহলে আপনার দেহে সেই মৌসুমের রোগগুলো প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বেড়ে যাবে। আমদানিকৃত ফলের চেয়ে দেশজ সিজনাল ফল অধিক স্বাস্থ্যসম্মতও। কারণ হলো দেশি ফলে ক্ষতিকর কেমিকেল ও প্রিজারভেটিভের অনুপস্থিতি।
বাজারে পাকা আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তরমুজ, ডেউয়া, লটকন, কালো জাম, গোলাপ জাম, বেতফল, গাব, জামরুল, আতাফল, কাউ, শরীফাসহ নানা ফলের সমাহার। আর এই সব নানান ফলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক।
বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলে (অত্যবশ্যকীয় কারণে) কৃত্রিম প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়, যাতে সেগুলো দীর্ঘদিন ভালো থাকে। কারণ আমদানি-রপ্তানি, হোলসেল-রিটেইলের পুরো প্রক্রিয়া শেষে ফলগুলো ভোক্তার প্লেট অব্দি পৌঁছাতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। এই প্রিজারভেটিভ শরীরের জন্যে ক্ষতিকর।
অন্যদিকে, দেশি সিজনাল ফল জোর করে পাকানোর প্রয়োজন যেমন পড়ে না, তেমনি প্রয়োজন হয় না দীর্ঘদিন সংরক্ষণেরও। কাজেই এগুলোতে ক্ষতিকর কেমিকেল ব্যবহার করার দরকার পড়ে না। এ কারণে দেশি ফলের স্বাদগন্ধ অটুট থাকে, ফল থাকে টাটকা ও ফ্রেশ। হজমও হয় দ্রুত।
কাজেই যারা কার্বাইড বা অন্যান্য ক্ষতিকর কেমিকেলের ভয়ে ফল খেতে চান না, তাদের জন্যে সহায় হলো দেশি মৌসুমি ফল। অবশ্য সেজন্যে ফলের সিজন পুরোদমে শুরু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম।
কেবল দেহের স্বাস্থ্যের জন্যেই না, সিজনাল ফল আপনার পকেটের স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালো! কারণ দেশজ বলে এগুলো তুলনামূলক সস্তা। এক কেজি আপেল কিনতে আপনি যে টাকা ব্যয় করবেন তা দিয়ে আপনি তিন কেজি আম, বা চার কেজি আমড়া কিংবা পাঁচ কেজি ওজনের পাকা কাঁঠাল কিনতে পারবেন অনায়াসে। দেশি ফলে অধিক পুষ্টি মেলে! দেশি ফল দামে সস্তা বলে নাক সিঁটকাবেন না যেন! দেশজ ফলগুলো পুষ্টিগুণে দামী বিদেশি ফলের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং অনেকক্ষেত্রেই ভালো।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমলকীর কথা। কমলার চেয়ে ২০ গুণ এবং আপেলের চেয়ে ১২০ গুণ বেশি ভিটামিন সি আছে আমলকীতে। ছোট্ট একটি আমলকীতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা আপনি আস্ত দুটি কমলাতেও পাবেন না!
আম-এ অবাক করার মতোই এর পুষ্টিগুণ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ক্যান্সার প্রতিরোধেও আম কার্যকরী। এতে থাকা বেশ কয়েক ধরণের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিউকেমিয়া এবং ব্রেস্ট, কোলন ও প্রোস্টেট ক্যান্সার থেকে দেহকে সুরক্ষা দেয়।
জাতীয় ফল কাঁঠালকে আমরা বলতে পারি ফলের মহারাজ! কারণ এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর ফলগুলোর একটি। এই ফল একাধারে বলকারক, রোগ প্রতিরোধক এবং ফর্সাকারক।
আপেল আঙ্গুর কমলায় আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যতখানি বাড়বে তার চেয়ে বহুগুণে বাড়বে কাঁঠাল খেলে। প্রতিদিন ৮/১০ কোষ কাঁঠাল দুইবেলা খেলে সারাবছর আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে অটুট। বাড়তি পাওনা হবে উজ্জ্বল মসৃণ ত্বক।
বাজারে এখনো জাম পাওয়া যাচ্ছে। খুবই পুষ্টিকর এই ফল। এর বিচি ডায়বেটিসের জন্যে ভালো। আয়ুর্বেদে ডায়বেটিসের ওষুধের মূল উপাদান হচ্ছে জামের বিচি। কেবল আম-কাঁঠালই না, খেতে হবে সব ধরণের মৌসুমি ফল। গ্রীষ্মকালে দেশে আরও যেসব ফল উৎপন্ন হয়- জামরুল, সফেদা, তরমুজ, বাঙ্গি, লিচু, ডেউয়া বা বনকাঁঠাল, আতা ইত্যাদি। এগুলোর কিছু কিছু আপনি এখনো বাজারে পাবেন।
বর্ষার অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল জাম্বুরা বা বাতাবীলেবু। স্বগোত্রীয় কমলা বা মাল্টাকে আমরা যতটা গুরুত্ব দেই তার সিকিভাগও দেই না জাম্বুরাকে। কারো কারো ধারণা হলো জাম্বুরা গরীবের ফল! কিন্তু পুষ্টিগুণে কমলা-মাল্টার চেয়েও অনেক বেশি উপকারি জাম্বুরা। বিশেষত যারা ঠান্ডার সমস্যায় বেশি ভোগেন তারা সিজনে প্রতিদিন অর্ধেক জাম্বুরা খেলে বেশ উপকার পাবেন।
পুষ্টিবিদদের মতে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। বিদেশি ফল দিয়ে এই চাহিদা মেটানো বেশ কঠিন ও ব্যয়বহুল। কিন্তু আমরা যদি মৌসুমি দেশজ ফল পর্যাপ্ত খাই তাহলে ফলের চাহিদা যেমন পূরণ হবে, তেমনি হবে অর্থের সাশ্রয়ও।