ইসলামী সভ্যতায় নারীর ভূমিকা শুধু হাদিস ও ফিকহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং শিল্প-সাহিত্যেও মুসলিম নারীরা বিশেষ অবদান রাখেন। রাসুলের যুগে যেসব নারী কবি খ্যাতি অর্জন করেন তাদের একজন কবি খানাসা (রা.)। যিনি সমকালের বহু পুরুষ কবিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।
নাম ও পরিচয়: তুমাদির বিনতে আমর ইবনুল হারিস সুলামিয়্যা। ছোট নাকবিশিষ্ট হওয়ায় তাকে খানাসা নামে ডাকা হতো। তিনি ইসলামের আগমনের আগে ও পরে উভয় সময়ে কবিতা রচনা করায় তাকে ‘মুখাদরিমিন’-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইসলাম আগমনের আগেই তিনি কবি খ্যাতি লাভ করেন।
ইসলাম গ্রহণ: বিশুদ্ধ মতানুসারে হিজরতের অষ্টম বছর কবি খানাসা (রা.) নিজ গোত্রের লোকদের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি নিজেকে এবং নিজের সাহিত্য-প্রতিভা ইসলামের সেবায় নিযুক্ত করেন।
গণমানুষের কবি: কবি খানাসা (রা.) ছিলেন গণমানুষের কবি। তাঁর কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরত। কবি নাবেগা জিবয়ানি খানাসা (রা.)-এর বিপুল জনপ্রিয়তা বোঝাতে বলেছিলেন ‘খানাসা হলেন মানুষ ও জিনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি।’ (আল-আদাবুল ইসলামী ওয়া তারিখুহু ফি উসুরিহি, পৃষ্ঠা ৬১)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রশংসা: আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) লেখেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কবি খানাসা (রা.)-এর কবিতা পছন্দ করতেন, তাঁর কবিতা আবৃতি করতেন এবং তিনি তাঁর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন—‘তোমাকে অভিনন্দন হে খানাসা!’ (আল-ইসাবা : ৮/৩৪)
ইসলামের জন্য আত্মত্যাগ : ১৬ হিজরিতে ওমর (রা.)-এর শাসনামলে কবি খানাসা (রা.) তাঁর পুত্রকে মুসলিম বাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেন এবং তাদের ইসলামের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর চার পুত্রই কাদেসিয়ার যুদ্ধে শহিদ হন। তাদের শাহাদাতের সংবাদ শুনে তিনি আবৃতি করেন ‘সব প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি আমাকে তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন, আশা করি—তিনি আমাদের তার রহমতের ছায়াতেও একত্র করবেন।’ (আল-হিওয়ারু মিন সাহাবাতির রাসুল, পৃষ্ঠা ৭৬)
ইসলামের জন্য তার এ আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ‘উম্মুশ-শহিদ’ বা শহীদ জননী উপাধি লাভ করেন। অন্যদিকে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ফরমান জারি করেন যে খানাসা (রা.) যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন তিনি চার সন্তানের জন্য বরাদ্দ অর্থ লাভ করবেন।
সাহিত্যচর্চা: আরবি কবিতার প্রায় সব শাখায় খানাসা (রা.)-এর বিচরণ ছিল। তৎকালীন আরব সভ্যতা ও মরু অঞ্চলের প্রায় সব উপাদান তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে। যেমন ধুলাবালি, ঝড়-বৃষ্টি, উট-তরবারি, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি। তবে তিনি শোক কবিতা রচনায় বিশেষ দক্ষতা দেখান। ভাই সাখার ও মুয়াবিয়ার জন্য শোক কবিতা লিখে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি সাখারের শোকে লেখেন, সাখার আমাকে কাঁদিয়ে চলেছ আজ/অথচ আমাকে হাসিয়েছ এতকাল/যেহেতু ছিল সে ছিল না দুঃসময়/আজ কে তাড়াবে বেদনার জঞ্জাল/আহাজারি করা বেমানান হয় হোক/তোমার শোক তো জগতে শ্রেষ্ঠ শোক।
মৃত্যু: ২৪ হিজরি মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ৭১ বছর বয়সে মহান এ কবি ইন্তেকাল করেন।