Site icon The Daily Moon | Popular Bangla News | National | International | Education | Entertainment | Religion | Employment

রাজপথে ডাক্তার-পুলিশ-মেজিস্ট্রেট বিতণ্ডা ও কিছুকথা

ফাতিহুল কাদির সম্রাট

ফাতিহুল কাদির সম্রাট: রাজপথে ডাক্তার-পুলিশ-মেজিস্ট্রেট বিতণ্ডার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। শিক্ষিত ও দায়িত্বশীল মানুষদের ক্ষমতা ও প্রভাবের এই সদম্ভ বাড়াবাড়ি আমাদের বড়ই লজ্জিত করেছে। আমজনতা তাকিয়ে তাকিয়ে এসব বিচ্ছিরি ব্যাপার দেখছে আর মরমে মরছে।

দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি বলেই মনে হয়। পিজি হাসপাতালের এসোসিয়েট প্রফেসর ঐ নারী ডাক্তার গাড়ি করে যাচ্ছিলেন হাসপাতালে। তাঁর গায়ে এপ্রোন ও গাড়িতে চিকিৎসকের স্টিকার ছিল। তিনি পরিচয়পত্র বহন করেননি, এবং তার সাথে মুভমেন্ট পাসও ছিল না। পুলিশি জেরা গাড়ি আটকানোতে ডাক্তার সাহেবা ভীষণ ক্ষেপে যান।

এক পর্যায়ে পুলিশ-মেজিস্ট্রেটকে তুই-তুকারি করেন এবং তুই-তুকারি করে তিনি ভুল করেননি সে কথা সদম্ভে উচ্চারণ করেন। তার এই ভাষা প্রয়োগ মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ডাক্তার পথের ওপর দাঁড়িয়ে বলেন, আজ দেখব কে বড়, কে ক্ষমতাবান, পুলিশ না ডাক্তার। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে চলে এই বিশ্রী বিতণ্ডা। খবর পেয়ে ডাক্তারের সহকর্মীরা আসেন এবং ঘটনার যবনিকা ঘটে।

ভিডিওর নিচে পাবলিক কমেন্ট দেখলে বোঝা যায় পাবলিক দুই পক্ষে বিভক্ত। আমি কোনো পক্ষেই যেতে পারছি না। আমি শুধু লজ্জিতই হচ্ছি। পেশাগত ক্ষমতা ও প্রভাব প্রয়োগের এই উলঙ্গ প্রকাশের ফাঁক দিয়ে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বটা উৎকট হয়ে উঠেছে। সংবিধান বলছে জনগণ দেশের মালিক। আর জনগণ দেখছে তারা আসলে দেশের কেউ না।

আমার কাছে ডাক্তার সাহেবার আচরণ অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক মনে হয়েছে। অপরদিকে আইন প্রয়োগকারীদের আচরণও পরিস্থিতি বিবেচনায় বিবেচিত মনে হয়নি। লকডাউন শুরুর দিনেই ডাক্তার হয়রানির অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে ডাক্তার সমাজের তীব্র ক্ষোভ এখনো প্রশমিত হয়নি। এ অবস্থায় তাদের উচিত ছিল আরেকটু নমনীয় হওয়া। পরিচয়পত্র না থাকলেও ডাক্তার হিসেবে তার পরিচয় বুঝে নেওয়ার মতো বুদ্ধিমত্তা পুলিশ ও মেজিস্ট্রেটের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল।

অনেকের ধারণা, ডাক্তারের প্রতি কিছু অসঙ্গত কথা বলা হয়ে থাকতে পারে। নইলে ভদ্রমহিলা এতটা ক্ষুব্ধ হতেন না। স্বাচিপ পিজি হাসপাতাল শাখা তাদের প্রতিবাদলিপিতে অভিযোগ করেছে, ঐ ডাক্তারকে কারান্তরীণ পাপিয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছিল। অভিযোগ সত্যি হলে তা অত্যন্ত আপত্তিকর ও দুঃখজনক।

ঘটনার এক পর্যায়ে ডাক্তার সাহেবা নিজেকে একজন বীর প্রতীকের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিলে পুলিশ অফিসার ও মেজিস্ট্রেটও নিজেদের মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে দাবি করেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান হিসেবে এভাবে পরিচয় দেওয়া আমার কাছে মোটেই ভালো মনে হয়নি। যাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে কোনো জাগতিক প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিল না।

সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে তাঁদের সন্তানসন্ততিদের বিশেষ কিছু সুযোগ দিয়েছে। এই সুযোগ দিতে গিয়ে সরকারকে তুলনামূলক মেধাবীদের সুযোগবঞ্চিত করতে হয়েছে। এই সুবিধায় তাঁদের পরিতৃপ্ত থাকা উচিত। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্যে দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি প্রয়োগ করা যাবে না এমনতো কোনো কথা হতে পারে না। ডাক্তার সাহেবার কথায় তাই মনে হতে পারে। মাত্র কদিন আগে বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ করায় নগদ জরিমানা গুণেছেন, ঘটনাটি আমাদের সামনেই কিন্তু আছে।

আমরা জাতি হিসেবে আর যাই হোক সভ্য হবো না কোনোদিন ঐ ঘটনায় এটা আবারও প্রতীয়মান হয়েছে। আমাদের পেশাজীবী ও চাকুরিজীবীরা কাজের অধিক্ষেত্রে নিজেদের রাজা-বাদশাহ ভাবতে তৎপর। তারা ভুলে যান যে, রাষ্ট্রকর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব আর যাই হোক কর্তৃত্ব প্রদর্শনের অনুষঙ্গ নয়। ক্ষমতা যে দায়িত্বের আদলে অক্ষমতারই প্রমাণ সেটা এদেশে কেউ মনে রাখেন না। সবাই মনে রাখেন না জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। কয়েক বছর আগে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে এক ইনসিডেন্টে পুলিশের একজন সেপাই দম্ভ ভরে বলেছিলেন, দেশের রাজা পুলিশ।

প্রশাসনের লোকদের কারো কারো আচরণে রাজা রাজা ভাব। ডাক্তার প্রকৌশলীরা নিজ নিজ পেশায় অবিকল্প। তাই তাদের অনেকের মাঝেও হামবরা ভাব। চাকুরি ও পেশা ক্ষেত্রে যার যেখানে সুযোগ আছে সে সেখানে অন্যদের ঠেক দিতে মরিয়া। কেউ বন্দুক উঁচিয়ে, কেউ আইনের এখতিয়ারে, কেউ ফাইল আটকে, কেউ শল্যচাকুর পোচ দিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায়ের সাথে সাথে বড়ত্ব ফলাতে চাইছে। আমরা যারা শিক্ষক-অধ্যাপক তারা অবশ্য সাতেপাঁচে নেই। এ দেশে আমাদের কেউ পুছে না।

নিজেদের ছাই ফেলার ভাঙা কুলো অবস্থা দেখে কষ্ট ভুলতে কেউ ইন্টারনেট ঘেটে দেখি কোন দেশে শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে বেশি, কোন দেশে আদালতে কেবল অধ্যাপকদের বসবার অনুমতি আছে, কোন দেশে চলার পথে শিক্ষকদের টোল দিতে হয় না, এসব। অনেকে সমাজ সংসার রাষ্ট্র পরিবার সর্বত্র অবজ্ঞার শিকার হয়ে অক্ষমের সান্ত্বনা স্বরূপ কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি আনমনে আওড়ান।

আমরা যারা শিক্ষিত, যারা সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত, তারা কখনো কি ভেবে দেখেছি আমাদের পড়ালেখার পেছনে দেশের মানুষের কত টাকা খরচ হয়েছে? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার কতখানি খালি হয়েছে? এই যে মাস শেষে বেতন-বোনাস একাউন্টে অটো ঢুকে যাচ্ছে তার যোগান কে দেয়? সাধারণ মানুষ যারা রাষ্ট্রের আইনগত মালিক, যাদের দানে শিক্ষা লাভ করেছি, বেতনভাতা, বাড়ি, গাড়ি, পিয়ন-চাপরাশি পাচ্ছি আমরা তো তাদের সেবকমাত্র। তাদের সামনে আমরা যখন ক্ষমতার জারিজুরি দেখাই তারা যদি সামনে এসে আস্তিন গুটিয়ে দাঁড়ায় তাহলে আমাদের অবস্থাটা কী হবে? এদেশে আকাট বোকা জনগণ আস্তিন গোটাতে না শেখা পর্যন্ত এই সেবকের স্বেচ্ছাচার শেষ হবে না।

একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিটি পেশা বৃত্তি ও কাজ গুরুত্বপূর্ণ। বহুজনের বহুবিধ কর্মসম্পাদনের মাধ্যমে জগতের চাকা ঘোরে। একজন আরেকজনের ওপর অনিবার্যভাবে নির্ভরশীল। বর্জ্য ফেলার মানুষটি না থাকলে, মুদি দোকানি দোকান না খুললে, কিষাণ হাল বাইলে কী হবে একবার কি ভেবে দেখেছি? প্রতি পেশা, বৃত্তি ও কাজ সম্মানের। সভ্য দুনিয়ায় এ সম্মান আছে। আর আমরা পদ পদবি, ক্ষমতা আর অর্থের কাছে আত্মসমপির্ত। প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োজিত প্রতিটি কর্মচারী সমান। সবাই জনগণের সেবক। কিন্তু বাস্তবে সেবকের দেখা মেলে না এদেশে। পদ, দায়িত্ব, কর্তৃত্বসহ বহুকিছুর মানদণ্ডে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যেও ব্রাক্ষ্মণেতর ব্যবধান। এই ব্যবধান বড়ই যন্ত্রণাদায়ক অনেকের জন্যে।

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই, ডাক্তার মেডামের আচরণকে ব্যক্তিক ক্ষ্যাপামি বা তাৎক্ষণিক ক্রুদ্ধতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। ডাক্তার সমাজের মনে বহুদিনের ক্ষোভ ও হতাশা পুঞ্জিভূত । করোনাকালে ডাক্তাররা মৃত্যুর বেসাতি দেখতে দেখতে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ও মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত। তারা এ সময়টাতে অন্তত সবার কাছ থেকে সহানুভূতি ও স্বীকৃতি আশা করলেও তারা তা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ সময় অধিকাংশ ডাক্তারের আচরণ অনেকখানি অস্বাভাবিক, ক্ষ্যাপাটে। অধিকাংশ ডাক্তার এখন কেন বিসিএস দিয়ে অন্য ক্যাডারে চলে যেতে মরিয়া তার পেছনের কারণ খুঁজে দেখাটা জরুরি। এটা না দেখা পর্যন্ত ডাক্তারদের মনোভাব পরিবর্তন হবে না। আমি অন্তত এমনটাই বিশ্বাস করি। কারণ আমার পরিবারে ডাক্তার আছে।

করোনা এসে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বাহাদুরি সব ফক্কিকার। অক্সিজেনের সাগরে ডুবে থেকেও সে বেঘোরে মারা যায় শুধু একবুক অক্সিজেনের অভাবে। দিনশেষে মানুষ বড়ই অসহায়। ক্ষমতা শুধু একজনের। সেই সর্বময় ক্ষমতাবানের কাছে আমরা নত হই, মনের সকল অহংকে ছুড়ে ফেলে দিই। স্মরণ করি-

“এই আছি এই নাই ওরে এই আছি এই নাই
দুদিন পরে কেউবা ধুলো কেউবা হবো ছাই।”

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ

Exit mobile version