ফাতিহুল কাদির সম্রাট: যা অনুমিত ছিল তাই হয়েছে। ভারত অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে অক্সিজেনের চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভারত থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সিংহভাগ অক্সিজেন উৎপাদন করে বহুজাতিক কোম্পানি লিন্ডে বিডি। লিন্ডের একাধিক প্লান্ট আছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কোম্পানি টু কোম্পানি চুক্তির আওতায় লিন্ডের ভারতীয় প্লান্ট থেকে চাহিদামতো অক্সিজেন বাংলাদেশে আসত। ভারত সরকারের এই বিধিনিষেধের কারণে সে সাপ্লাই চেইনটি কাটা পড়ল।
করোনাকালে অক্সিজেনের আকাশচুম্বী চাহিদার কারণে ভারত সরকার এর আগেই অক্সিজেন কোম্পানিগুলোকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করে শুধু মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদনের নির্দেশ দিয়েছে। অক্সিজেন কালোবাজারি ও মজুদদারি বন্ধ করার জন্যে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়েছে। সামরিক বিমানে করে অক্সিজেন কন্টেইনার পরিবহনের ব্যবস্থা কেরছে। সেনা ও পুলিশ স্কট দিয়ে অক্সিজেনবাহী গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করেছে। জরুরিভাবে অক্সিজেন আমদানির ব্যবস্থা নিয়েছে। জার্মানি থেকে ২৩টি মোবাইল অক্সিজেন প্লান্ট আমদানি করেছে। এই প্লান্টগুলো এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং সরাসরি বাতাস থেকে অক্সিজেন আহরণ করে সাপ্লাই দিতে সক্ষম।
ভারতে অক্সিজেনের জন্যে বলা যায় কেয়ামত ঘটে যাচ্ছে। এই করুণ অবস্থার মধ্যে রপ্তানি বন্ধের জন্যে ভারত সরকারকে দোষারোপ করা যায় না। ভারতের সরকার তার জনগণকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে নিষ্ঠুর হলেও কারো কিছু বলার নেই। কিন্তু আমাদের যদি চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায় তাহলে কী হবে? দেশে অক্সিজেন উৎপাদনকারী কোম্পানি মাত্র তিনটি। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ইচ্ছে করলেও রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়। অক্সিজেনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় চলে যাচ্ছে। হাতপা গুটিয়ে বসে থেকে পরে পারস্পরিক দোষারোপ ও নিয়তির চৌকাঠে মাথা ঠোকার কোনো মানে হয় না।
করোনা এসে উন্নয়নের ধারণাকে ধাক্কা দিয়েছে। প্রযুক্তির অবিমৃশ্যকারী ব্যবহারের অসারতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। ভারতের হাতে থাকা দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আর দেমাগের অনুষঙ্গ পরমাণু অস্ত্র একজন মানুষেরও প্রাণ বাঁচাতে কাজে লাগছে না। কাজে লাগছে অক্সিজেনভর্তি সিলিন্ডার। ঝলমলে শহরায়ন, ভোগ্যবস্তুর পসার, চোখ ধাঁধানো অবকাঠামো মানে যে উন্নতি নয় সেটি আজ প্রমাণিত।
আমরা জন্মের পর থেকে উন্নয়ন রাজনীতির কথা শুনছি। উন্নতি মানে প্রশস্ত রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, সুউচ্চ দালান এইসব। অধুনা উন্নতির ইন্ডিকেটর হয়ে উঠেছে মাথাপিছু আয়, ফ্লাইওভার, দীর্ঘ সেতু, টানেল-আন্ডারপাস এই সব। মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রতি নজর না দিয়ে আমরা মনোযোগ দিয়েছি জীবন সাজানোর প্রতি। আজ আমরা বুঝতে পারছি একটি উন্নত হাসপাতাল বা একটি অক্সিজেন প্লান্ট হাজারটা বড় অবকাঠামোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। থরে বিথরে স্নাতক-স্নাতকোত্তরের চেয়ে একজন ডাক্তার বা বিজ্ঞানগবেষক অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ব্যাংক লুঠ করে মালয়েশিয়া-কানাডা-দুবাইয়ে সেকেন্ড হোম বানিয়েছি। সুইস ব্যাংকের গর্ভ ভরিয়েছি দুর্বৃত্তায়নের টাকায়। ঘুষ-দুর্নীতির টাকার অবাধ প্রবাহে ভোগের বিলাতে মেতেছি।
আমাদের উন্নয়নধারণা অসার প্রমাণিত। অধিকাংশ মানুষের এক সপ্তাহ চলার মতো সঞ্চয় নেই অথচ দেশে হু হু করে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা। বাড়ছে মাথাপিছু আয়। বিষয়টি অর্থনীতির এক প্রপঞ্চ হিসেবেই স্বীকৃত।
ধান ভানতে শিবের গীত থাক। ভারতের পেটের মধ্যে আছি আমরা। আমাদের ঝুঁকি তাই উচ্চমাত্রায়। এই অবস্থায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি ও অনুরোধ রাখছি। প্রয়োজনে মোবাইল প্লান্ট আমদানির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমরা চাই না আমাদের চোখের সামনে আমাদের প্রিয়জনদের নারকীয় যন্ত্রণার মৃত্যু হোক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ