গত কিছু দিন “বিতর্ক” শব্দটি পত্রপত্রিকায় খুব ঘন ঘন এসেছে, যদিও আমার মনে হয়েছে শব্দটি যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি। কোনও একটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে হলে তার পক্ষে যে রকম যুক্তি থাকতে হয় ঠিক সে রকম বিপক্ষেও যুক্তি থাকতে হয়। যদি একটা বিষয়ের বিপক্ষে গলায় জোর ছাড়া অন্য কোনও যুক্তি না থাকে তখন সেটাকে ‘বিতর্কিত’ বিষয় বলা হলে বিষয়টিকে নিয়ে অনেক বড় অবিচার করা হয়।
আমাদের দেশে সম্প্রতি ঠিক এটাই করা হয়েছে। পত্রপত্রিকায় আলোচনা চলছে যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ‘বিতর্ক’ হচ্ছে, এমনকি স্বয়ং মন্ত্রীরা ঘোষণা দিয়েছেন অতি শিগগিরই এই বিতর্কের অবসান ঘটানো হবে। তাহলে কী মেনে নেওয়া হলো যে এই দেশে ভাস্কর্য একটি বিতর্কিত বিষয় এবং এই শিল্পটি শেখার আগে, প্রয়োগ করার আগে, কিংবা উপভোগ করার আগে আমাদের চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন আছে?
মানুষ শুধু একটা বুদ্ধিমান প্রাণী নয়, তাদের ভেতর সৌন্দর্য অনুভব করার, উপভোগ করার এবং সেটি সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে। এটি একটি সহজাত প্রবৃত্তি, একটি অবোধ শিশুকেও মা সুর করে ঘুম পাড়ানি গান শুনিয়ে শান্ত করেন। আমরা কবিতা পড়ি, আবৃত্তি করি এবং কবিতা লিখি। আমরা গান শুনি, রাত জেগে ক্লাসিক্যাল সংগীত উপভোগ করি। পৃথিবীতে কত ভিন্ন ভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়েছে, মানুষের ভেতর কত রকম সুর। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সেগুলো বিকশিত হয়েছে কিন্তু তাদের ভেতর এক ধরনের বিস্ময়কর মিল আছে। আমরা ছবি আঁকি, মুগ্ধ হয়ে একটা সুন্দর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছি, যে শিশুটি এখনও দুই পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারে না, তাকেও কোলে নিয়ে একটি অপূর্ব পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়ালে সে মুগ্ধ চোখে সেটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
সৌন্দর্য উপভোগ করা মানুষের একটি সহজাত ক্ষমতা, একটা ছোট শিশুর মস্তিষ্কটিতেও সেটি বিকশিত হতে শুরু করে। জশুয়া বেল নামে একজন জগদ্বিখ্যাত বেহালাবাদক রয়েছেন, যার বেহালা শোনার জন্য শ্রোতারা শত শত ডলার দিয়ে কনসার্ট শুনতে যান। একবার তাঁকে রাজি করানো হয়েছিল যে তিনি ভিখিরি সেজে ওয়াশিংটন ডিসির মেট্রোরেল স্টেশনে বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষে করবেন, রেলযাত্রীদের প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা পরীক্ষা করে দেখা হবে। বড় মানুষেরা তার বেহালা বাজানোকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করে চলে গেছে। ছোট শিশুরা জশুয়া বেলকে চিনে না কিন্তু তারপরেও মুগ্ধ হয়ে তার বেহালা শুনতে চেয়েছে, তার সামনে থেকে নড়তে চায়নি। অবাক হবার কিছু নেই, শিল্পকলার জন্য ভালোবাসা আমাদের রক্তের ভেতর থাকে, এই ভালোবাসাটুকুই আমাদের পৃথিবীর অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করে রেখেছে।
সেজন্য আমরা একেবারে শৈশব থেকে শিশুদের শিল্পকলা শেখাতে চাই। আমাদের পাঠ্যসূচিতে আমরা শিল্পকলা যুক্ত করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চারুকলা বিভাগ রয়েছে, শিল্পীমনা ছেলেমেয়েরা সেখানে ছবি আঁকা শিখতে যায়। আমাদের দেশে নাটকের দল আছে, তারা মঞ্চে নাটক করে আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি। নৃত্যকলা বিভাগ আছে, সেখানে ছেলেমেয়েরা নাচ শিখে। আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক নৃত্য সম্মেলন হয়, সারা পৃথিবী থেকে সেখানে নৃত্যশিল্পীরা আসেন, আমরা এই অপূর্ব শিল্পকলাটি দেখে মুগ্ধ হই। আমাদের দেশে আমরা চলচ্চিত্র উৎসব করি, সেখানে সারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলো দেখানো হয়।
কোভিডের এই দুঃসময়ে ঘরবন্দি মানুষের সময় কাটানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঘরে বসে চলচ্চিত্র উপভোগ করা। একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র একটি দেশের মানুষের ভেতর গভীর দেশপ্রেমের জন্ম দিয়েছে, পৃথিবীতে সেরকম উদাহরণের কোনও অভাব নেই। এই শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত করার জন্য আমরা এই দেশে শিশু চলচ্চিত্র উৎসব পর্যন্ত আয়োজন করে থাকি। শিল্পকলা একটা জাতির মানসিক বিকাশের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ, তাই পৃথিবীর সব দেশে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থাকে, আমাদের দেশেও আছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাংস্কৃতিক চর্চাকে উৎসাহ দেওয়া হয়, বিকশিত করা হয়।
নানা ধরনের শিল্পমাধ্যমের মতো ভাস্কর্য একটি শিল্পমাধ্যম। যারা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যগুলো যারা নিজের চোখে একবার দেখেছে তারা কখনোই সেগুলো ভুলতে পারবে না। ওয়াশিংটন ডিসিতে লিংকন মেমোরিয়াল হলের ভেতর শ্বেতপাথরের তৈরি আব্রাহাম লিংকনের একটি বিশাল এবং অপূর্ব ভাস্কর্য রয়েছে। ফ্লোরেন্সে রয়েছে মাইকেল এঞ্জেলোর তৈরি পৃথিবীর অন্যতম ভাস্কর্য ডেভিড, একজন রক্ত-মাংসের মানুষ যে এরকম একটি শিল্পকর্ম তৈরি করতে পারে সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। ভ্যাটিকানে রয়েছে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর পিয়েতা নামে আরও একটি অপূর্ব ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যগুলো আমি নিজের চোখে দেখতে পেরেছি বলে সব সময় নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছি। একসময় দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগতো—আজকাল দেশের বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না, যদি কোথাও যাই তখন সেখানকার আর্ট মিউজিয়ামে পেইন্টিং বা ভাস্কর্যগুলো দেখতে পাবো সেটিই একমাত্র আকর্ষণ হিসেবে রয়ে গেছে। রাশিয়ার সুবিশাল ভাস্কর্য “মাতৃভূমির ডাক” নিজের চোখে দেখার একটি গোপন ইচ্ছা মাঝে মাঝে বুকের ভেতর জেগে ওঠে।
ভাস্কর্য একটি অসাধারণ শিল্পমাধ্যম, পৃথিবীর মানুষ হিসেবে সেই মাধ্যম দেখার, উপভোগ করার এবং সৃষ্টি করার অধিকার আমার জন্মগত অধিকার। কেউ যদি আমাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায় তাহলে সে আসলে আমাকে আমার মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে! সেটি কি কেউ করতে পারে? কারও যদি সেটি উপভোগ করার ক্ষমতা না থাকে কিংবা উপভোগ করতে না চায় তাহলে সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার পুরো অধিকার তার আছে। কিন্তু তারা কোনোভাবেই অন্যদের সেটা থেকে বঞ্চিত করার কথা বলতে পারবে না। সেই অধিকার কেউ তাকে দেয়নি।
ভাস্কর্যের বিরোধিতা কি ওখানেই থেমে থাকবে? নাকি এই বিরোধিতা ধীরে ধীরে আমাদের দেশের অন্য শিল্পমাধ্যমের জন্যেও প্রযোজ্য হতে শুরু করবে? আমরা সবাই জানি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ভেতর সেটা এর মাঝে ঢুকে গেছে। তাদের আবদার শুনে আমাদের সিলেবাস থেকে “বিধর্মীদের” লেখা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাস হয়, বাংলাদেশে এটা ঘটেছে? তাদের বিবেচনায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিশ্চয়ই একজন “বিধর্মী”, তার লেখা জাতীয় সংগীত সরিয়ে দেওয়ার কথাবার্তা কি আমরা মাঝে-মধ্যেই শুনতে পাই না? যেসব কারণে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করা হয় তার সবগুলো কি ছবির বেলাতেও প্রযোজ্য নয়? তাহলে এই দেশ থেকে ছবিও কী ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ করার দাবি শুরু হবে না? সেখানে কী শেষ হয়ে যাবে? তারপর কি নৃত্যকলা বন্ধ করার দাবি আসবে? মঞ্চে নাটক করা, চলচ্চিত্র কী নিরাপদ থাকবে? আমরা তখন কী করবো? সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়কে একটি অপ্রয়োজনীয় মন্ত্রণালয় হিসেবে বন্ধ করে দেবো?
যাই হোক, আমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করি না—এটি শুধু আমার ক্ষোভের কথা। কিছু ধর্মান্ধ মানুষের অযৌক্তিক কথা শুনে দেশের মূল আদর্শ থেকে, স্বপ্ন থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে যাবো সেটা কখনোই হতে পারে না। তাই সামনের কয়েকটা দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ—আমরা এখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে চাই এই রাষ্ট্র এখন কী সিদ্ধান্ত নেয়। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছুড়ে ফেলে দেওয়ার আস্ফালন করা হয়েছে, এই দেশে বঙ্গবন্ধু শুধু একজন মানুষ নন, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ সমার্থক। তাই বঙ্গবন্ধুর অবমাননা আর বাংলাদেশের অবমাননার মাঝে খুব বড় পার্থক্য নেই।
আমি জানি না আমাদের রাষ্ট্র কী এখন অনুভব করতে পারছে যে এখন এই ধর্মান্ধ মানুষদের অর্থহীন কাজকর্মের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়ার সময় হয়েছে? স্পষ্ট করে এখনই তাদের জানিয়ে দিতে হবে তাদের ঠিক কতটুকু সীমানার ভেতরে থাকতে হবে?
তাদের কাছে যদি অন্য কোনও যুক্তি পৌঁছানো না যায় অন্তত একটি যুক্তি নিশ্চয়ই পৌঁছানো যাবে, পবিত্র কোরআন শরিফে অনেকবার সীমা লঙ্ঘনকারীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। তারা যেটা করছে, সেটা যদি সীমা লঙ্ঘন না হয়ে থাকে তাহলে কোনটা সীমা লঙ্ঘন?
লেখক: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক