ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত ১৩ জনের প্রাণহানী হয়েছে। নরেন্দ মোদির বাংলাদেশে আগমনের পর গত শুক্রবার থেকে আজ রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গণমাধ্যমে আসা খবরের বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে এ সংখ্যাটা আরও বেশি বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির আমির আল্লামা আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী।
হেফাজত আমিরের দাবি, হাটহাজারীতে নিহত চারজনসহ এখন পর্যন্ত সারাদেশে সংগঠনটির ১৬ জন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। একইসঙ্গে এতে অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া গত দুদিনে গ্রেফতার হওয়াদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়ারও দাবি জানিয়েছেন তিনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত শুক্রবার (২৬ মার্চ) সকাল ১১টার দিকে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এদিকে তার এ সফরকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকদিন থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ-সমাবেশ করে আসছে একাধিক সংগঠন। সর্বশেষ মোদির আগমনের পর শুক্রবার জুমার নামাজের শেষে বিক্ষোভ করে হেফাজতে ইসলাম। এতে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে এ সংঘর্ষের উত্তাপ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
শুক্রবার (২৬ মার্চ) বিকেলে চট্টগ্রামে অন্তত ৪ জনের মৃত্যু
মোদির সফরের প্রতিবাদে রাজধানী ঢাকার বায়তুল মোকাররম এলাকায় শুক্রবারের নামাজের পর বিক্ষোভ হয়। ওই এলাকায় কয়েক ঘন্টা ধরে পুলিশ-বিক্ষোভকারী ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। এতে সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। দেশের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ঢাকার ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হলে বেশ কয়েকজন আহত হয়। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পর আমরা মোদিবিরোধী মিছিল বের করেছিলাম। মিছিল থানার সামনে যাওয়ার পর পুলিশ বিনা উস্কানিতে আমাদের ওপর গুলি চালায়। এতে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন- হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম, মেহরাজ, মো. জামিল এবং আবদুল্লাহ নামের অপর এক ব্যক্তি।
শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিহত ১ জন
নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এদিন একদল মাদ্রাসার ছাত্র বিক্ষোভ মিছিল বের করে। পরে তাদের সাথে আরেকটি মাদ্রাসার ছাত্ররা যোগ দেয়। এসময় হাটহাজারীতে সহিংসতায় মৃত্যুর খবর পৌঁছলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালায়।
স্থানীয় পত্রিকা একুশে আলোর সম্পাদক সেলিম পারভেজ বলেন, বিক্ষোভকারীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনে অগ্নিসংযোগ করে এবং শহরে বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালায়। তারা বেশ কিছু গাড়িতেও অগ্নি সংযোগ করে। এ সময় বিক্ষোভকারীদের দমাতে পুলিশ গুলি করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজন মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়।
শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিহত ৫ জন
শনিবার বিকেলে সদর উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে মোদী বিরোধীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘হাসপাতালে আনার আগেই তিন জন মারা যান। বাকী দুজন হাসপাতালে মারা গেছেন। তারা গুলিবিদ্ধ ছিলেন।’
এ ঘটনায় নিহতরা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার হারিয়া গ্রামের ওয়ার্কশপ শ্রমিক জোহর আলম (৪০), মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামের সুজন মিয়া (২০), বুধল ইউনিয়নের কাউসার মিয়া (২৫) এবং সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্রমিক বাদল মিয়া (২৮)। এছাড়া কান্দিরপাড়া এলাকায় সংঘর্ষে নিহত ছাত্রের নাম জুবায়ের (১৪)।
রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরও ৩ জনের মৃত্যু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে হাইওয়ে থানায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুই জন মারা গেছে। এছাড়া জেলা শহরের পীরবাড়ি এলাকায় পুলিশ লাইনে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের হামলার পর সেখানে গুলিবিদ্ধ আরেকজন হাসপাতালে মারা গেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক সৈয়দ আরিফুল ইসলাম জানান, প্রথম দুই জন ছাড়াও বিকেল ৩টার দিকে গুলিবিদ্ধ আরেকজন মারা যান। প্রায় চল্লিশ বছরের অজ্ঞাতপরিচয় এই ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় শহরের পীরবাড়ি এলাকা থেকে দুপুর সোয়া ২টার দিকে কয়েকজন নিয়ে এসেছিল।
গুলিতে নিহতরা হলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের খাঁটিহাতা গ্রামের আলতাফ আলী ওরফে আলতু মিয়ার ছেলে হাদিস মিয়া ওরফে কালন মিয়া (২৩) এবং সরাইল উপজেলা সদরের কুট্টাপাড়া গ্রামের সুফি আলীর ছেলে আল আমীন (২০)।
নিহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দাবি হেফাজতের
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে শুক্রবার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষোভের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দাবি করে সরকারকে গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলছে তারা।
হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী এক বিবৃতিতে গুলিবর্ষণের জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এভাবে পুলিশের গুলিবর্ষণের ন্যক্কারজনক ঘটনা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। এর জবাব প্রশাসনকে অবশ্যই দিতে হবে এবং অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এ আন্দোলন দেশ কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে ছিল না উল্লেখ করে পুলিশের গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি জানান, এসব দাবি বাস্তবায়ন না হলে হেফাজতে ইসলাম সামনে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। সারাদেশের হেফাজত নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে এসব কর্মসূচি দেওয়া হবে। এছাড়া এসময় তিনি হাটহাজারী থানার ওসি রফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করার দাবি জানান। তিনি বলেন, শুক্রবার জুমার নামাজের পর হেফাজত নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভে হামলায় হাটহাজারী থানার ওসি রফিকুল ইসলাম নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই ঘটনায় আমরা তাকে প্রত্যাহার দাবি করছি।