আমার পায়ের অঙ্গুলের ডগা থেকে শুরু করে হাতের আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত তিরতির করে কাঁপছে বিশ্বাস ভঙের কষ্টে, হেরে যাওয়ার উত্তেজনায়। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে জীবন থেকে পালিয়ে যেতে, অদৃশ্য হয়ে যেতে, আড়াল করে ফেলতে নিজেকে।
উনিশ বছর ধরে বুকের প্রকোষ্ঠে স্বগর্বে যে মিথ্যার প্রাসাদ আমি লালন করেছি, গড়ে তুলেছি সেটা নিমিষে শুকনো পাতার মতো মরমর করে ভেঙে গুড়িয়ে গেছে।
আমি নির্বাক কেবল চেয়ে রয়েছি।
কীভাবে অফিসে গিয়ে রহমান সাহেবের চোখের দিকে তাকাব, সেই চিন্তায় আমার ঘাম দিয়ে জ্বর চলে আসছে। যাকে গতকালও অফিসে বসে তিরষ্কার করছি। তার লোভী স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জীবন পার করার জন্য, অনুশোচনা করেছি।
প্রেমময় স্ত্রীর স্বামী, বাবার প্রতি যত্নশীল সন্তানের পিতা হতে পেরে নিজেকে নিয়ে একসমুদ্রসম গর্ব ছিল এক জীবন আমার।
আমি আমজাদ হোসেন। কাজ করি একটা বেসরকারি অফিসে ক্লার্ক পদে। বেতন বেশি না। হাজার দশেকের মতো। উপরি পাওনা একদমই নেই বললেই চলে। থাকি জেলা শহরে। গ্রামে থাকে দুটি সন্তান আর স্ত্রী। বড় ছেলে, ছোট মেয়ে। ছেলেটা এবার দশম শ্রেণিতে আর মেয়েটা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।
নিজের খরচ পরিবারের খরচ সাথে বাচ্চাদের লেখাপড়া, এত অল্প আয়ে ঠিকমতো চলতে পারি না। হিমসিম খেয়ে যাই। সে জন্য অফিসের আগে পরে দুটো টিউশনি করি। টিউশনি থেকে আয় বেশি না। ১০০০ করে ২০০০ টাকা। যেটা দিয়ে বাচ্চাদের প্রাইভেটের বেতনের টাকাটা হয়।
আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে করি। প্রতি মাসে দু’বার বাড়িতে যাই। স্ত্রী রাত জেগে বসে থাকে আমার জন্য, সাথে থাকে দুটি সন্তান। বাবার পথ চেয়ে মায়ের গা ঘেসে বসে থাকে ওরাও অনেক রাত অবধি। বাবা আসার সময় তাদের জন্য চকলেট, চিপস নিয়ে আসে তারা দুহাত ভরে সেগুলো নিয়ে হাসিমুখে রুমে চলে যায়।
বাচ্চাদের মুখের এমন পবিত্র হাসির জন্য আরো দুটো টিউশনি করতে ইচ্ছে করে। পাপ হবে জেনেও অফিস থেকে কিছু উপরি পাওনায় ভাগ বসাতে ইচ্ছে করে।
আমি মাসে দু’দিন বাড়ি থাকি। বউ হাসিমুখে ঘুরঘুর করে আমার পাশে। আমার পছন্দের খাবার রান্না করে। আমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে। আমার মতো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারির এক জীবনে আর কী চাই।
উনিশ বছর ধরে এই সত্যটা আমি জানি। এই সত্যের জোরে বন্ধু মহলে সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করে, কেউ কেউ হিংসাও করে। অনেক বেশি বেতনের বন্ধুরাও ব্যক্তি জীবনে এত সুখী না।
স্ত্রী সন্তানের নজর কেবল বাবার পকেটের দিকে। কোনোভাবেই টাকার ঘাটতি হলেই সবার আলস রূপ বেরিয়ে আসে। আমার ওদের জন্য কষ্ট হতো। সন্তানদের মানুষ করতে পারেনি, স্ত্রীকে ভালোবেসে বুঝিয়ে বলতে পারেনি বলে আপসোস হতো।
নিজেকে দুনিয়ার সুখী মানুষ বলে মনে হতো কত অল্প বেতনে চাকরি করেও স্ত্রী সন্তান নিয়ে কত ভালো আছি। ওদের বাড়তি কোনো চাহিদা নেই।
উনিশ বছর ধরে ভেতরে ভেতরে এই মিথ্যাটা লালন করে আমি সুখে ছিলাম।
আজ যখন বন্ধুর ছেলের অপারেশনের টাকা যোগাড় করতে পারছিল না বলে হাত পেতেছিল। আমার কাছে ছেলের স্কুলের বেতন, মেয়ের শিক্ষকের বেতন, বউয়ের শাড়ির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, বন্ধুর ছেলের অপারেশনের টাকা দেয়া। তাই বেতনের টাকা পুরোটা হাসপাতালে গিয়ে রাজিবের হাতে তুলে দিয়ে সোজা চলে এলাম বাড়িতে। খুব খুব খারাপ লাগছিল নিজের ছেলেটার জন্য রাজিবের ছেলেটাও আমার ছেলের বয়সী। অথচ স্কুলে যাওয়ার পথে রোড এক্সিডেন্টে ডান পা ভেঙে গেছে। আমার ছেলেটাও যে সাইকেল নিয়ে স্কুলে যায়।
একবুক সমান দরদ, মায়া, প্রেম, ভালোবাসা, মমতা নিয়ে খালি পকেটে রাতেই রওনা দিয়ে বাড়ি ফিরলাম স্ত্রী সন্তানের কাছে।
প্রয়োজনে দু’দিন পরে স্কুলের বেতন দেব, না হয় পরের মাসে একসাথে দেব। কী হবে?
আমার বাড়ি পৌঁছাতে পোঁছাতে বেজে গেলো রাত তিনটে। দরজা নক করায় শায়লা দরজা খুলে দিয়েছে। শায়লা আমার স্ত্রী। আমাদের উনিশ বছরের সংসার জীবন। ওকে হয়তো প্রাচুর্য দিতে পারিনি, তবে অভাবে কখনো রাখিনি। ওকে বিয়ে করে সিগারেট খাওয়া ছেড়েছি। সেই টাকা জমিয়ে তার জন্য শাড়ি কিনেছি, কসমেটিক্স কিনেছে। শায়লা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে, বাড়ি আসার দিন, কিছু আনতে না পারলে এক কেজি মিষ্টি হলেও নিয়ে এসেছি।
শায়লা খুশি হতো, ওর হাসি মুখ দেখে আমি তৃপ্তি পেতাম।
স্বাভাবিকভাবে প্রতিবারের মতো রাতটুকু কেটেছে। সকালে বাচ্চারা বাবাকে দেখে ভীষণ খুশি। কারণ আজ আমার বাড়ি আসার কথা ছিল না। আমি বৃহস্পতিবার ছাড়া বাড়ি আসি না, অথচ আজ মঙ্গলবার।
ছেলে এসে লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে গেলো, তার স্কুলের বেতন, প্রাইভেট শিক্ষকের বেতন, পিকনিকের বিলসহ মোট দুই হাজার টাকা লাগবে। মেয়ে লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে গেলো, তার স্কুল ড্রেসে কলমের কালি লেগেছে, সেটা বানাতে হবে, প্রাইভেট স্যারের বেতন দিতে হবে আরও কিছু মিলিয়ে তারও প্রায় দুইা হাজার টাকা লাগবে।
বাচ্চাদের মায়ের বেশি কিছু না। একটু বাবার বাড়ি বেড়াতে যাবে। ফল মিষ্টির জন্য শ’পাঁচেক হলেই হবে।
সবার সব বায়না শেষ হবার পর আমি স্বাভাবিকভাবে বললাম-
‘বাবারা এ-মাসে কোনোভাবে কাটিয়ে দাও। আমি যাওয়ার ভাড়াও আনতে পারিনি। ইনশাল্লাহ আগামী মাসের প্রথম পনেরোর ভেতর চেষ্টা করব, তোমাদের শিক্ষকের বেতন দিয়ে দিতে। এ বছর পিকনিকে যেতে হবে না। তোমার রাজিব আঙ্কেলের…’
আমার কথা শেষ হতে না দিয়েই সাথে সাথে ছেলে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল
‘এসব কী কথা! আমি স্যারকে স্কুলে গিয়ে কী বলব? পিকনিকে যেতেই হবে, বেতন দিতেই হবে! আজ মাসের ২৯ তারিখ।’
রাগে গজগজ করতে করতে ছেলে সামনে থেকে সরে গেলো। আমি যতবারই ডাকলাম, সে কাছেও এলো না। মেয়ে এবার স্কুল ড্রেস না বানাতে পারার দুঃখে রীতিমত বিলাপ করে কাঁদছে। বান্ধবীরা কী বলবে সে দুঃখে তার চোখে সাগর নেমেছে।
বাচ্চাদের মা আরো বেশি রাগান্বিত।
‘আমি বাবার বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করলেই, তোমার টাকা থাকে না। লাগবে না আমি কোথাও যাব না। শুধু বাচ্চাদের বেতনের টাকাটা দিয়ে দিও।’
অগ্নিমূর্তি ধারন করে তিনিও আমার সামনে থেকে চলে গেলেন।
আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি, আমার হাতের আধা ছেঁড়া শুকনো রুটির দিকে। আজ রুটি দিয়েই তিনজন সামনে থাকে সরে গেছে। না আছে রুটির সাথে খাওয়ার জন্য সবজি বা ডিম, না আছে চা, না আছে পানি।
হঠাৎ করে আমার চেনা জগৎ এমন অচেনা হয়ে যাওয়ায়, আমার পায়ের নিচের মাটি যেন কাঁপতে শুরু করল। আমার হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। বুকের ভেতর স্ত্রী সন্তানের গর্বে বড় হয়ে যাওয়া হৃদপিণ্ডটা যেন লজ্জায়, অপমানে, অসম্মানে, ভয়ে চুপসে গেছে।
আমি উঠে রুমে চলে এলাম। ভীষণ অপরাধবোধ কাজ করছে। কেন ঝোঁকের মাথায় সব টাকা দিয়ে খালি হাতে বাড়ি এলাম। অন্য দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু টাকা নিয়ে দু’দিন পর কেন আসিনি, ভীষণ রাগ হচ্ছিল নিজের প্রতি। বাচ্চাদেরকে বুঝিয়ে বলার জন্য ওদের কাছে গেলাম, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।
অথচ রাগে কেউ ফিরেও তাকাল না। জোর করে জড়িয়ে ধরলাম। অথচ কোনো আবেগ নেই, মমতা নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। সবকিছু কেমন যেন অচেনা।
সারা দিন বাড়ি ছিলাম। অথচ বাচ্চাদের পাশাপাশি ওদের মায়ের আচরণও যেন কেমন প্রশ্নবিদ্ধ। খুব একটা কাছে আসছে না। যে ভালোবাসা নিয়ে সময়ের দু’দিন আগে রাতের আঁধারে আমি ছুটে এসেছি, সেটার যেন কোনো গুরুত্বই নেই। আমি টাকা ছাড়া কেন এসেছি? ওরা স্কুলের বেতন, পিকনিকের বিল কোথা থেকে দেবে, সবাই সে চিন্তায় তটস্থ।
পুরো চব্বিশ ঘণ্টা অচেনা, দমবন্ধ করা এক পরিবেশে থেকে, আমি রাতের আঁধারে ঝাঁপসা চোখে পা বাড়ালাম উদেশ্যহীন দিগন্তের মাঝে। আর পিছনে ফেলে আসলাম আমার বিশ্বাসে, ভালোবাসায় গড়া মমতার সংসার। যেখানে তিনজন রক্তেমাংসে গড়া মানুষ বসবাস করে।
যাদের কাছে আমার কোনো মূল্য নেই, গুরুত্ব নেই। শুধু টাকা হলেই চলবে। আমার উপস্থিতি এদের কাছে অর্থহীন। একবার পিছনে ফিরে চেয়ে দেখলাম আমার শিকড়কে। এবার আমি অচেনা পথিক হবো। দায়িত্ব এড়িয়ে যাব না। মাস শেষ টাকা পাঠিয়ে দেবে, তবে এপথে আর নয়। আমি হাঁটতে, হাঁটতে চলে এলাম বড় রাস্তার মোড়ে। তখন গভীর রাত। চারদিকে জোনাকি পোকার আলো দেখা যায়। আমি বিস্তৃত দিগন্তে মেলে ধরলাম, আমরা ঝাঁপসা চোখ জোড়া।
পৃথিবীটা সত্যি মিথ্যা মায়ার মুখোশে আচ্ছাদিত।